শিল্প উৎপাদনে রোবটিক্স প্রযুক্তি স্থাপনে নজির গড়েছে রেড জায়ান্ট চীন!
একবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সাথে তাল মিলিয়ে শিল্প উৎপাদনে গতিশীলতা আনতে সারা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বর্তমানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) প্রযুক্তি সমৃদ্ধ রোবটের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রোবটিক্স (আইএফআর)-এর সাম্প্রতিক তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী ভারি শিল্প উৎপাদন বা ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ইনস্টল হওয়া নতুন শিল্প-রোবটের প্রায় ৫২% চীনেই ইনস্টল করা হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী শিল্প-রোবট বাজারে দেশটির একচেটিয়া আধিপত্যের চিত্র ফুঁটে উঠেছে।
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রোবটিক্স (আইএফআর) এর প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে,
গত ২০২৪ সাল পর্যন্ত চীন তাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব বা শিল্প-কারখানাগুলোতে মোট প্রায়
৩,৫০,০০০ (সাড়ে তিন লাখ) ইউনিট নতুন রোবট ইনস্টল করেছে, যা গত ২০২২ সাল অপেক্ষা প্রায়
২০% বেশি। এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি ২০২৫ সালেও চীন বিশ্ব শিল্প-রোবট বাজারের শীর্ষ
স্থান ধরে রাখবে বলে প্রতিয়মান হয়।
অন্যদিকে, শিল্পোৎপাদনে রোবট ব্যবহারের দিক দিয়ে চীন ব্যাপকভাবে এগিয়ে গেলেও বিশ্বের অন্যান্য প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি এবং প্রযুক্তি সমৃদ্ধ দেশগুলো মোটেও পিছিয়ে নেই। ২০২৪ সালের তথ্যমতে, জাপান প্রায় ৫৫,০০০ ইউনিট, যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৪৩,৫০০ ইউনিট, দক্ষিণ কোরিয়া প্রায় ৩৩,০০০ ইউনিট, জার্মানি প্রায় ২৮,০০০ ইউনিট এবং ভারত মোট প্রায় ৭,২০০ ইউনিট নতুন শিল্প-রোবট ইনস্টল করেছে।
বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল রোবটিক্স
বাজারে পরিণত হয়েছে। দেশটি ‘Make in India 2.0’ কর্মসূচির আওতায় স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং,
ইলেকট্রনিক্স ও অটোমোবাইল শিল্পে এআই নির্ভর রোবটিক্স প্রযুক্তি দ্রুত সম্প্রসারণ করছে।
যদিও ইনস্টলেশনের সংখ্যায় চীনের তুলনায় অনেক পিছিয়ে, তবু প্রবৃদ্ধির হার ও প্রযুক্তিগত
স্বনির্ভরতার দিক বিবেচনায় ভারত এখন বিশ্বের অন্যতম উদীয়মান রোবটিক্স শক্তি হিসেবে
আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে।
এই তথ্য বা পরিসংখ্যানটি শুধু কেবল একটি বছরের জন্য নয়, বরং গত ২০২৪ সাল পর্যন্ত
দেশগুলোর ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ইনস্টলকৃত বা ব্যবহৃত মোট রোবটের সংখ্যা প্রকাশ করা
হয়েছে। তবে বিশেষ করে জাপানের মোট রোবট সংখ্যা চীনের তুলনায় যথেষ্ট কম হলেও, উৎপাদনশীলতা
ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার বিচারে দেশটি এখনও বৈশ্বিকভাবে শীর্ষস্থানে রয়ে গেছে।
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প-রোবটের ব্যবহার এখনো পর্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের
অ্যাডভান্সড ম্যানুফ্যাকচারিং, ডিফেন্স সিস্টেম ও সেমিকন্ডাক্টর খাতে কেন্দ্রীভূ্ত
রয়েছে এবং অন্যদিকে সার্বিকভাবে রোবট ব্যবহারের বিচারে শীর্ষস্থানে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া।
তাছাড়া বর্তমানে ইউরোপের রোবটিক্স হাব হিসেবে আআত্মপ্রকাশ করেছে জার্মানি। দেশটি বিশেষত
অটোমোটিভ ও ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে ব্যাপক হারে এআই প্রযুক্তি সমৃদ্ধ রোবটের ব্যবহার ব্যাপক
হারে বৃদ্ধি করেছে।
আইএফআর-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০২৩ সালে সারা বিশ্বে প্রতি ১০ হাজার শিল্পকর্মীর
বিপরীতে গড়ে ১৬২টি শিল্পরোবট ব্যবহার করা হয়েছে। ২০১৬ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৭৪টি।
মাত্র সাত বছরে রোবটের ব্যবহার দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে যাওয়া চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের গতির
স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। তবে রোবট ব্যবহারের গড় তথ্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে আরও চমকপ্রদ কিছু
তথ্য।
আন্তর্জাতিকভাবে রোবট ব্যবহারের মাত্রা নির্ধারণে যে মাপকাঠি ব্যবহার করা হয়,
তা হলো প্রতি ১০ হাজার কর্মীর বিপরীতে ঠিক কতটি রোবট ইনস্টল করা আছে। আর এই তালিকায়
শীর্ষে আছে দক্ষিণ কোরিয়া, যেখানে প্রতি ১০ হাজার কর্মীর বিপরীতে ব্যবহৃত হয় আনুমানিক
১,০১২টি রোবট। তাছাড়া বৈশ্বিক পর্যায়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকা সিঙ্গাপুরের সংখ্যাটি ৭০৫টি,
তৃতীয় স্থানে জাপান আনুমানিক ৪০০টি এবং বিশেষ করে চতুর্থ স্থানে থাকা জার্মানি ও চীনে
যৌথভাবে গড়ে প্রায় ৩৮০-৪২০টি রোবট ব্যবহার করে।
পরিশেষে বলা যায়, বিগত চার দশক ব্যাপী পরিকল্পিতভাবে শিক্ষা, শিল্প ও প্রযুক্তিগত
উন্নয়ন নিশ্চিত করার ফলে চীন কার্যত বাস্তবে একেবারে শূন্য থেকে খুব দ্রুত উচ্চ প্রযুক্তির
শীর্ষস্থানে পৌঁছে গেছে। বর্তমানে চীনের নিজস্ব ইন্ডাস্ট্রিয়াল লেভেলের উৎপাদনশীলতা
ও সক্ষমতা দেখলে অবাক না হয়ে পারা যায় না। বিশেষ করে ওয়ার্ল্ড ট্রেড রিপোর্ট ২০২৪ অনুযায়ী
চীনবৈশ্বিক বিশ্বের রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ১৪.৮% নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও বৈশ্বিক শিল্প
উৎপাদন শৃঙ্খল (global supply chain) এর হয়ত প্রায় ৪০% নিয়ন্ত্রণ করে চীন।
তথ্যসূত্র (References):
1.
International Federation of Robotics (IFR). World Robotics
Report 2024.
2.
Ministry of Heavy Industries, Government of India. Make in
India 2.0: Industrial Automation Roadmap, 2024.
3.
United Nations Conference on Trade and Development
(UNCTAD). World Trade Report 2024.
লেখক পরিচিতি:
সিরাজুর রহমান, (Sherazur Rahman), শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ।
লেখক নোট:
এই নিবন্ধটি প্রস্তুতিতে আধুনিক গবেষণা সরঞ্জাম (AI টুল) ব্যবহার করে তথ্য
যাচাই ও প্রাসঙ্গিক পরিসংখ্যান সংযোজন করা হয়েছে। তবে লেখাটির বিষয়বস্তু, গঠন ও চূড়ান্ত
রূপান্তর লেখকের নিজস্ব।


.jpg)
Comments
Post a Comment