প্রাণের খোঁজে শনির চাঁদ টাইটানে নাসার এক বৈপ্লবিক “ড্রাগনফ্লাই” স্পেস মিশন!
সৌরজগতের বিস্ময়কর রিং বলয় ঘেরা শনিগ্রহ এবং তার বৃহত্তম চাঁদ “টাইটান” বর্তমানে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের কাছে একে বিজ্ঞানীদের কৌতূহলের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। বিশেষ করে "টাইটান" উপগ্রহ তার ঘন বায়ুমণ্ডল, তরল মিথেনে গঠিত নদী ও হ্রদ, বরফে ঢাকা পৃষ্ঠ এবং এর অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা সম্ভাব্য তরল জলের অস্তিত্বের জন্য বিজ্ঞানীদের কাছে বরাবরই গবেষণার এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে।
আমাদের সোলার সিস্টেমে “টাইটান” উপগ্রহে বিদ্যমান এসব অতি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের জন্য পৃথিবীর বাইরে এতে এলিয়েন লাইফ বা প্রাণের সম্ভাব্য আবাসস্থল হিসেবে বিবেচনা করেন বিজ্ঞানীরা। এবার এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে যাচাই করতে চায় NASA। এজন্য নাসা এক অতি উচ্চাভিলাষী এবং ব্যয়বহুল রোবটিক স্পেস মিশন পরিচালনা করতে যাচ্ছে, যার নাম দেয়া হয়েছে ‘ড্রাগনফ্লাই’ (Dragonfly) স্পেস মিশন।
নাসার এই উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা অনুযায়ী, ‘ড্রাগনফ্লাই’ (টাইটান স্পেস প্রোব) মিশন আগামী ২০২৮ সালের জুলাই মাসে ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হবে। প্রায় ৬ বছরের যাত্রা শেষে এটি আগামী ২০৩৪ সালে শনির উপগ্রহ টাইটানে বুকে অবতরণ করে এর মূল বৈজ্ঞানিক ও গবেষণামূলক কার্যক্রম শুরু করবে।
নাসার পরিকল্পনা অনুযায়ী, ‘ড্রাগনফ্লাই’ মিশনটি প্রায় ১০ বছর দীর্ঘ হবে, যার মধ্যে টাইটানে পৌঁছানোর পর প্রায় ২ বছর ৬ মাসজুড়ে চলবে নিবিড় বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও অনুসন্ধান কার্যক্রম। নাসার ‘New Frontiers Program’–এর আওতায় পরিচালিত এই মিশনের মোট ব্যয় হতে পারে আনুমানিক ৩.৩৫ বিলিয়ন ডলার বা তারও বেশি।
‘ড্রাগনফ্লাই’ (Titan rotorcraft lander) মিশনের প্রস্তাব প্রথম ২০১৭ সালের শুরুতে Johns Hopkins University Applied Physics Laboratory (APL) থেকে NASA-এর “New Frontiers Program”-এ জমা দেওয়া হয়। এরপর ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে, NASA এই প্রস্তাবটিকে জমাকৃত বারোটি প্রস্তাবের মধ্যে থেকে দুইটি চূড়ান্ত প্রতিযোগীর একটি হিসেবে নির্বাচিত করে, যাতে এই মিশনের ধারণা ও কার্যক্রম আরও উন্নত ও পরিমার্জিত করা হয়।
এরপর দীর্ঘ মূল্যায়ন ও প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণের পর গত ২৭ জুন ২০১৯ সালে, NASA ড্রাগনফ্লাই মিশনকে তাদের পরিচালিত “New Frontiers Program”-এর আওতায় চতুর্থ স্পেস মিশন হিসেবে চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করে। পরবর্তীতে, গত ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে, NASA আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ড্রাগনফ্লাই’ (টাইটান স্পেস প্রোব) মিশনের সমস্ত প্রযুক্তিগত দিক যাচাই ও বিশ্লেষণ করে পূর্ণ অনুমোদন দেয়। যার আলোকে এখন চূড়ান্ত পরিকল্পনা, স্পেসপ্রোব নির্মাণ ও উৎক্ষেপণের যাবতীয় প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে নাসা।
আসলে টাইটান হলো শনির (Saturn) সবচেয়ে বড় চাঁদ এবং সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক উপগ্রহ। যেহেতু শনি গ্রহের কক্ষপথ উপবৃত্তাকার (elliptical) এবং পৃথিবীরও কক্ষপথ পরিবর্তনশীল, তাই পৃথিবী ও টাইটানের মধ্যকার দূরত্ব সময়ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে পৃথিবী থেকে টাইটানের গড় দূরত্ব হতে পারে প্রায় ১.২ বিলিয়ন কিলোমিটার বা ১২০ কোটি কিলোমিটার।
অন্যদিকে শনিগ্রহের অন্যতম রহস্যময় উপগ্রহ “টাইটান” হচ্ছে আমাদের সোলার সিস্টেমের একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ, যার রয়েছে নিজস্ব ঘন বায়ুমণ্ড। বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী, টাইটানের বায়ুমণ্ডলের প্রায় ৯৭ শতাংশ নাইট্রোজেন দিয়ে গঠিত। পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও এমন ঘন বায়ুমণ্ডলের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তবে টাইটানের নিজস্ব ঘন বায়ুমন্ডল থাকলেও এটি হচ্ছে কিন্তু একটি চরম শীতল পরিবেশ। বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী, টাইটান উপগ্রহের গড় তাপমাত্রা হতে পারে প্রায় ৯৪ কেলভিন বা -১৭৯.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর এই অতি নিম্ন তাপমাত্রার কারণে এখানে পানির পরিবর্তে ভূপৃষ্ঠে মিথেন ও ইথেন তরল অবস্থায় টিকে রয়েছে। এগুলো নদী, হ্রদ ও সাগরের মতো গঠন তৈরি করেছে বলে ধারণা করেন বিজ্ঞানীরা।
এর আগে নাসার পাঠানো ক্যাসিনি-হাইগেনস (Cassini-Huygens) মহাকাশযান ২০০৪ সালের ১ জুলাই শনি গ্রহে প্রবেশ করে এবং ২০০৪ সালের ১৪ জানুয়ারী হাইগেনস প্রোব টাইটানের সারফেসে অবতরণ করে। এই হাইগেনস মিশনের তথ্য অনুযায়ী, টাইটানের পৃষ্ঠে রয়েছে পর্বত, উপত্যকা ও মেঘের অস্তিত্ব, যা সম্ভবত পৃথিবীর প্রাচীন পরিবেশের সঙ্গে অনেক মিল দেখা যায়।
হাইগেনস মিশন থেকে প্রাপ্ত ডাটা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে, টাইটানের অতি শীতল বরফের নিচে একটি বিশাল উপগ্লেসিয়াল তরল জলের মহাসাগর লুকিয়ে থাকতে পারে। যা এলিয়েন লাইফ বা জটিল প্রাণধারণের জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ হতে পারে। যদিও এই ধারণা হচ্ছে বিজ্ঞানীদের একটি প্রেডিকশন বা অনুমান মাত্র।
আর এই রহস্য উন্মোচনে এবার পরিকল্পিতভাবে সেখানে উচ্চ প্রযুক্তির ড্রাগনফ্লাই স্পেস মিশন আগামী ২০২৮ সালের মধ্যে শুরু করার মহা পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নাসা। আর ড্রাগনফ্লাই স্পেস-প্রোবটি হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) বা স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ এবং নিউক্লিয়ার এনার্জি চালিত ৮-রোটার বিশিষ্ট রোবটিক রোটারক্রাফ বা হেলিকপ্টার। যা অনেকটা বৃহৎ আকারের ড্রোনের মতো কাজ করতে সক্ষম। এটি Johns Hopkins University Applied Physics Laboratory (APL) কর্তৃক ডিজাইন ও তৈরি করা হচ্ছে।
ড্রাগনফ্লাই স্পেস প্রোবে শক্তি উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে MMRTG (Multi-Mission Radioisotope Thermoelectric Generator), যা প্লুটোনিয়ামের তাপ শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর করে। যার ফলে এটি যে কোন প্রতিকূল পরিবেশে এবং বিশেষ করে টাইটানের অতি শীতল ও বরফ আচ্ছাদিত পরিবেশে আলোর উপস্থিতি ছাড়াও দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে সক্ষম।
‘ড্রাগনফ্লাই’ (Dragonfly) স্পেস-প্রোবে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় নেভিগেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) সমৃদ্ধ অটোনোমাস নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। যা টাইটানের ঝুঁকিপূর্ণ ভূখণ্ডে নিরাপদে অবতরণ ও উড্ডয়ন নিশ্চিত করবে। এর ৮টি স্বাধীনভাবে নিয়ন্ত্রিত রোটর ব্লেড টাইটানের ঘন বায়ুমণ্ডলে স্থিতিশীলভাবে উড্ডয়ন করতে সক্ষম হবে।
এতে যুক্ত করা হয়েছে উচ্চ রেজোলিউশনের ক্যামেরা, স্পেকট্রোমিটার, ভূ-রাসায়নিক বিশ্লেষক, নমুনা সংগ্রাহক এবং তাপমাত্রা ও পরিবেশগত সেন্সর। যা দিয়ে এটি টাইটানের পৃষ্ঠের রাসায়নিক গঠন ও প্রাণের সম্ভাব্য উপাদান পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করবে। প্রতি ফ্লাইটে "ড্রাগনফ্লাই" প্রায় ৮ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়ে যেতে পারবে এবং পুরো মিশন চলাকালীন সময়ে এটি প্রায় ৮১ কিলোমিটার বা তার বেশি বিস্তৃত এলাকায় পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধান ও গবেষণা চালাতে পারবে।
নাসার বিজ্ঞানীদের মতে, ‘ড্রাগনফ্লাই’ (Dragonfly) স্পেস মিশনের মূল বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্য হলো যে, টাইটানের পৃষ্ঠ ও বায়ুমণ্ডলে প্রাক-জৈব রাসায়নিক অণু, জৈব যৌগ এবং জীবনের উপযোগী রাসায়নিক উপাদানের অস্তিত্ব খুঁজে বের করা। পাশাপাশি এটি মূল্যায়ন করবে টাইটানের বরফের নিচে থাকা তরল জলীয় পরিবেশে জীবাণু পর্যায়ের প্রাণ ধারণের সম্ভাবনা রয়েছে কি না।
আর যদি সত্যিই এমন কোনো জৈব-রাসায়নিক ইঙ্গিত বা প্রাণের চিহ্ন পাওয়া যায়, তবে তা হবে মানবজাতির ইতিহাসে অন্যতম চমকপ্রদ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। আর সব মিলিয়ে বলা যায়, ড্রাগনফ্লাই মিশন পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্ব সন্ধানে এক বৈপ্লবিক মিশন বা অধ্যায় হতে যাচ্ছে। এটি যদি সফল হয়, তবে কেবল টাইটান নয়, বরং আমাদের সোলার সিস্টেমে লুকিয়ে থাকা অন্যান্য বরফ-আবৃত উপগ্রহ যেমন ইউরোপা, এনসেলাডাস–এ রোবটিক স্পেস মিশন পরিচালনায় হয়ত নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
তথ্যসূত্র:
NASA science, Wikipedia, space.com, The Planetary Society, Dragonfly (The Johns Hopkins University Applied Physics Laboratory)
লেখক পরিচিতি:
সিরাজুর রহমান (Sherazur rahman) সহকারী শিক্ষক ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি লেখক গ্রাম: ছোট চৌগ্রাম, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com
Comments
Post a Comment