রহস্যময় মহাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা নক্ষত্রের শ্রেণি বিভাগ!




জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নক্ষত্রকে তাদের আকার, উজ্জ্বলতা, তাপমাত্রা এবং রঙের ভিত্তিতে ৭টি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। এই শ্রেণিগুলো হলো 'ও' (নীল), 'বি' (নীল-সাদা), 'এ' (সাদা), 'এফ' (সাদা-হালকা হলুদ), 'জি' (হলুদ), 'কে' (কমলা) এবং 'এম' (লাল) টাইপের নক্ষত্র। এছাড়া আমাদের চিরচেনা আকাশগঙ্গা ছায়াপথে প্রায় ১০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।




বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী, 'এম' টাইপের নক্ষত্রগুলো মহাবিশ্বের সবচেয়ে ঠান্ডা ও ক্ষুদ্র আকারের হয়ে থাকে। এদের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাত্র ৩,৭০০ কেলভিনের কাছাকাছি হতে পারে। কিন্তু আকারে ছোট ও ঠান্ডা হলেও এদের জীবনচক্র অত্যন্ত দীর্ঘ হয়ে থাকে। যা কয়েকশ বিলিয়ন বছর থেকে কয়েক ট্রিলিয়ন বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।



আমাদের পৃথিবী থেকে প্রায় ৪.২৬ আলোকবর্ষ দূরত্বে অবস্থিত প্রক্সিমা সেন্টুরাই হচ্ছে টাইপ "এম" ক্যাটাগরির নক্ষত্রের একটি বাস্তব উদাহরণ। এটিকে আসলে আমাদের পার্শ্ববর্তী একটি সৌরজগৎ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাধারণ দৃষ্টিতে ৪.২৬ আলোকবর্ষ দূরত্ব খুবই কম বলে মনে হলেও বাস্তবে সেখানে পৌঁছাতে হয়ত মানবজাতির তৈরি কোন দ্রুতগামী স্পেসক্রাফট এর আনুমানিক ৭০ হাজার থেকে ১ লক্ষ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে।



অন্যদিকে আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্রে অবস্থিত সূর্য হচ্ছে "জি" (হলুদ) টাইপের একটি মিডিয়াম লাইফ সাইকেলের নক্ষত্র। সূর্যের গড় তাপমাত্রা ৫,২০০-৬,০০০ কেলভিন এবং এর জীবনচক্র প্রায় ১০ বিলিয়ন বছর পর্যন্ত হতে পারে। সে হিসেবে, সূর্য তার জীবনচক্রের প্রায় অর্ধেক পথ অতিক্রম করেছে। তবে সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা অনেকটাই কম মনে হলেও বাস্তবে এর বায়ুমণ্ডল বা করোনার তাপমাত্রা অবিশ্বাস্যভাবে প্রায় ১-২ মিলিয়ন কেলভিন পর্যন্ত হতে পারে।



বিজ্ঞানীদের মতে, "ও" (O) টাইপ নক্ষত্র হচ্ছে মহাবিশ্বের সবচেয়ে গরম, উজ্জ্বল ও বিশাল নক্ষত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। অতি বিরল এই "ও" টাইপের নক্ষত্রের তাপমাত্রা প্রায় ৩০,০০০ কেলভিন বা তারও বেশি হতে পারে। এটি আকারের দিক দিয়ে সূর্যের চেয়ে বহু গুণ বড়ো এবং এর উজ্জ্বলতা সূর্যের চেয়ে লক্ষ গুণ বেশি হতে পারে।



"ও" টাইপের নক্ষত্র আকারের দিক দিয়ে খুবই বড়ো হলেও এর জীবনচক্র খুবই স্বল্পস্থায়ী হয়ে থাকে। যা মাত্র কয়েক মিলিয়ন বছর পর্যন্ত হতে পারে। এটি প্রতিনিয়ত মহাকাশে প্রচণ্ড পরিমাণে অতিবেগুনি রশ্মি (UV radiation) বিকিরণ ছড়ায় এবং এটি সাধারণত নক্ষত্রমণ্ডলে বা তরুণ গ্যালাক্সিতে দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া স্বল্প মেয়াদি জীবনচক্রের কারণে এই নক্ষত্রগুলো একটি স্থায়ী সৌরজগৎ গঠনের জন্য পর্যাপ্ত সময় ও উপাদান পায় না।



এই জাতীয় "ও" টাইপের নক্ষত্র তার মধ্যে থাকা জ্বালানি মাত্র কয়েক মিলিয়ন বছরের মধ্যে সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে নিঃশেষ করে ফেলে। যা থেকে নিউট্রন তারা বা ব্ল্যাক হোল তৈরি হতে পারে। এই নক্ষত্রগুলো মহাবিশ্বে ভারী মৌল তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি তার জীবনচক্র শেষে তার মধ্যে থাকা বিপুল পরিমাণ গ্যাস ও ধুলো নিক্ষেপ করে তার আশেপাশের গ্যাসীয় মেঘকে আয়নিত করে এবং নতুন নতুন নক্ষত্র সৃষ্টির কারখানা বা নার্সারিতে পরিণত হয়।



পরিশেষে বলা যায়, নক্ষত্রের শ্রেণিবিন্যাস শুধু মহাবিশ্বের গঠন ও বৈচিত্র্য নয়, বরং আমাদের মহাজাগতিক সময়, শক্তি ও পদার্থের রহস্যময় বৈশিষ্ট্য ও গতিপথের এক অনন্য পাঠ প্রদান করে। বিশেষ করে "ও" টাইপের সুপারজায়ান্ট (Supergiant) নক্ষত্রগুলো তাদের ক্ষণস্থায়ী অথচ প্রভাবশালী জীবনচক্রের মাধ্যমে মহাবিশ্বে এক নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে, যেখানে ধ্বংস মানেই সবশেষ নয়, বরং এক নতুন সৃষ্টির সূচনার দিগন্ত উন্মোচন করে।



তথ্যসূত্র: NASA, Wikipedia, space, LMOST, ESA, SeiTechDaily



লেখক পরিচিতি :

সিরাজুর রহমান, (Sherazur Rahman), শিক্ষক ও লেখক, গ্রাম : ছোট চৌগ্রাম, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com

Comments

Popular posts from this blog

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ছাপানো পবিত্র কুরআন মাজীদ!

ইএল ক্যাপ্টেন' এক অবিশ্বাস্য দ্রুত গতির সুপার কম্পিউটার!

প্রাণের খোঁজে শনির চাঁদ টাইটানে নাসার এক বৈপ্লবিক “ড্রাগনফ্লাই” স্পেস মিশন!