নতুন করে মহাকাশ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে বিশ্বের সুপার পাওয়ার দেশগুলো!

 



সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে স্পেস ওয়ারের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে বিশ্বের সুপার পাওয়ার দেশগুলো। আর এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমেরিকা, রাশিয়া এবং চীনের মতো দেশ নিজেদের স্পেস ফোর্স গঠন অনেক আগেই শুরু করে দিয়েছে। আর এই নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতায় একদিকে আমেরিকা এবং অপর দিকে রাশিয়া ও চীন যৌথভাবে নিজেদের স্পেস ফোর্স গঠন করে একে একে নতুন প্রযুক্তির অজানা সংখ্যক মিলিটারি স্যাটেলাইট ও স্পর্শকাতর কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ অবজেক্ট গোপনে পৃথিবীর অরবিটে বা আউটার স্পেসে প্রেরণ করে যাচ্ছে।

 

 

গত ২০২২ সালে থেকে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এসব প্রভাবশালী দেশ মহাকাশে বা আউটার স্পেসে সামরিক স্যাটেলাইট বা অস্ত্র প্রেরণের নিষেধাজ্ঞার আন্তর্জাতিক চুক্তি ও আইন অমান্য করেই নিজেদের মতো করে মহাকাশে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। আর এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে রেড জায়ান্ট চীন অত্যন্ত গোপনে গত ২০২৩ সাল থেকে জুন ২০২৪ পর্যন্ত অজানা মোট ৬টি স্পেস অবজেক্ট মহাকাশে পাঠিয়েছে বলে অভিযোগ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। চীনের এহেন গোপন কার্যকলাপের উপর ব্যাপক মাত্রায় নজরদারি অব্যাহত রেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন।


 

চীন ও রাশিয়ার আউটার স্পেসে মিলিটারি কার্যক্রম গভীরভাবে নজরদারি করার লক্ষ্যে অতি উচ্চ প্রযুক্তির এক মহাকাশযান এক্স-৩৭বি মিশন পরিচালনা করে আমেরিকা। একবিংশ শতাব্দীর নতুন এক ভয়ংকর কোল্ড ওয়ারের অংশ হিসেবে মহাকাশে যুদ্ধকে সামনে রেখে রাশিয়া এবং চীন কি ধরনের সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে তার উপর গোপন নজরদারি করাই এই স্পেস যানের মূল লক্ষ্য। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে যে, রাশিয়া ও চীন ইতোমধ্যেই স্যাটেলাইট বিধ্বংসী সক্ষমতা অর্জন করেছে। তবে তাতে চীন কোনো সাড়া না দিলেও রাশিয়া তা জড়ালোভাবে প্রত্যাখান করেছে।

 

 

 

এদিকে চলতি ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পৃথিবীর আউটার স্পেসে পরমাণু ও অন্যান্য সকল গণবিধ্বংসী অস্ত্র সংরক্ষণ, গবেষণা এবং মোতায়েন নিষিদ্ধ করে একটি বিল উত্থাপন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান। তাদের প্রস্তাবিত এই বিলের মূল উদ্দেশ্য ছিল শান্তিপূর্ণভাবে মহাকাশ ব্যবহার এবং মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতা পুরোপুরি বন্ধ করা। নিরাপত্তা পরিষদের মোট ১৫টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৩টি দেশ এর পক্ষে ভোট দিলেও নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাশিয়া এতে ভেটো দেয়। তাছাড়া চীন ভোট দান থেকে বিরত থাকে। আর এতেই প্রস্তাবটি পুরোপুরি বাতিল হয়ে যায়।

 

 

মহাকাশে বা আউটার স্পেসে চীন ও রাশিয়া গোপনে উচ্চ প্রযুক্তির সামরিক অবজেক্ট ধারাবাহিকভাবে পাঠাচ্ছে বলে আমেরিকা মিডিয়ায় বার বার অভিযোগ করে গেলেও বাস্তবে তাদের অতি উচ্চ প্রযুক্তির মহাকাশ যান এক্স-৩৭বি আসলে ঠিক কোন ধরনের স্পেস মিশন পরিচালনা করে তা নিয়ে কিন্তু টু শব্দটিও করে না আমেরিকা। এমনকি এই মহাকাশ মিশনে চীনের পাশাপাশি উত্তর কোরিয়া এবং ইরানের উপর বেশ কয়েক বার গোপনে নজরদারি চালিয়েছে আমেরিকা।

 

 

অথচ কোল্ড ওয়ার যুগে সত্তরের দশকে জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৬৭ সালের ২৭শে জানুয়ারি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকার পাশাপাশি বিশ্বের সকল প্রভাবশালী দেশ একত্রে আমাদের সোলার সিস্টেমকে অস্ত্র ও দূষণ মুক্ত রাখার জন্য ‘আউটার স্পেস ট্রিটি’ চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং তা কার্যকর করা হয় ১৯৬৭ সালের ১০ই অক্টোবর। বিশেষ করে ১৯৬৭ সাল থেকে ২০২৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত বিশ্বের মোট ১১৫টি দেশ এই আউটার স্পেস ট্রিটিতে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তির মূল বিষয়বস্তু হলো যে, পৃথিবীর বাহিরে আমাদের সোলার সিস্টেমের কোন গ্রহ, উপগ্রহ এবং অন্যান্য অবজেক্টের মালিকানা কোন দেশ কখনোই দাবি করতে পারবে না।

 

 


 

তার পাশাপাশি পৃথিবীর আউটার স্পেসে কোন বিস্ফোরক, পরমাণু, জৈব কিংবা অন্য কোন গণবিধ্বংসী অস্ত্র প্রকাশ্যে বা গোপনে কোন অবস্থাতেই মোতায়েন করতে পারবে না কোন দেশ। বিভিন্ন দেশের মহাকাশচারীরা স্পেস মিশনে গেলেও তা সমগ্র মানবজাতির প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত হবেন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমেরিকা, চীন ও রাশিয়ার মতো সুপার পাওয়ার দেশগুলো এই আউটার স্পেস ট্রিটিতে চুক্তি স্বাক্ষর করলেও বাস্তবে মহাকাশে নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য গোপনে কাজ করে যাচ্ছে।

 

 

গত ২০১৮-১৯ সালের দিকে চীন ও রাশিয়ার পাশাপাশি আমেরিকার সাবেক ট্রাম্প প্রশাসনের নিদের্শনায় নিজেদের জন্য হাই প্রোফাইল 'মহাকাশ বাহিনী' গঠনের কাজ শুরু করে । ভবিষ্যতে মার্কিন সামরিক বাহিনীর ষষ্ঠ শাখা হিসেবে মহাকাশেও মোতায়েন করবে দেশটির উচ্চ প্রশিক্ষিত সেনা ইউনিট। আর কয়েক বছর আগেই মহাকাশ বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে ভোট দেয় যুক্তরাষ্ট্রের হাউস আর্মড সার্ভিস কমিটি। তাদের সামরিক বাহিনীর ষষ্ঠ শাখা হিসেবে মহাকাশে বা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে গোপন সামরিক মিশন পরিচালনা করবে এবং প্রয়োজনে শত্রু দেশের বিরুদ্ধে মহাকাশ থেকেই যুদ্ধ করবে ইউএস স্পেস আর্মি ইউনিট।

 

 

তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সামরিক বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করেন যে, চীন, রাশিয়া এবং আমেরিকার মতো সুপার পাওয়ার দেশগুলো নতুন করে মহাকাশ দখলের যে ভয়ংকর প্রতিযোগিতা শুরু করেছে তাতে করে অদূর ভবিষ্যতে মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে আমাদের পৃথিবী, আউটার স্পেস। তাছাড়া পৃথিবীর লো এন্ড হাই অরবিটে ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে রেডিয়েশন, স্পেস জাঙ্ক বা মিলিয়ন মিলিয়ন টন আবর্জনা। তার সাথে ভবিষ্যতে মানুষের হাতে থাকা পরমাণু ও জৈব অস্ত্র গোপনে হয়ত পৌঁছে যেতে পারে পৃথিবীর আউটার স্পেসে।

 

 

 

এদিকে মহাকাশে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে বিগত তিন দশক থেকে অজানা সংখ্যক মিলিটারি স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে আমেরিকা, রাশিয়া এবং চীন। যার মধ্যে আনুমানিক দুই শতাধিক মিলিটারি স্যাটেলাইট প্রেরণ করেছে আমেরিকা। তাছাড়া রাশিয়া প্রায় শতাধিক এবং চীন প্রায় অর্ধশতাধিক মিলিটারি বা স্পেশাল মিশনের জন্য উচ্চ প্রযুক্তির মহাকাশ যান পাঠিয়ে মহাকাশ দখলের এক অশুভ খেলায় মেতে উঠেছে।

 

 

আসলে গত ২০০৭ সালে চীন পৃথিবীর লো আর্থ অরবিটে থাকা কোন এক স্যাটেলাইট ভূমি থেকে মিসাইল দিয়ে আকাশেই ধ্বংস করে দেয়। যা নিয়ে অবশ্য মার্কিন প্রশাসন চরম প্রতিবাদ জানায়। তবে তাতে কোন সারা দেয়নি চীন। অবশ্য তার পরের বছরই ২০০৮ সালে আমেরিকা নিজেই কিনা তাদের উচ্চ প্রযুক্তির এসএম-৩ মিসাইল সিস্তেম দ্বারা লো আর্থ অরবিটে থাকা একটি নিজেদের স্যাটেলাইট ধ্বংস করে এই খেলায় নিজের সাবলীল উপস্থিতির জানান দেয়।

 

 

গত ২০১৫ সালের দিকে সেই আশঙ্কাটা আরো জোরালো হয়েছিল রাশিয়ার পাঠানো একটি উপগ্রহের সন্দেহজনক গতিবিধিতে। অনেকেই আশঙ্কা করেন যে, স্পেসে শত্রুভাবাপন্ন দেশের পাঠানো গুরুত্বপূর্ণ স্যাটেলাইট বিকল বা ধ্বংস করে দিতেই এটি পাঠায় রাশিয়া। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, গত ২০১৯ সালের ২৭শে মার্চ ভারত পৃথিবীর লো আর্থ অরবিটে ৩০০ কিলোমিটার উচ্চতায় থাকা নিজেদেরই ইসরোর তৈরি একটি অচল স্যাটেলাইট মিসাইল আঘাত করে ধ্বংস করে দেয়। আর এই ধরনের কার্যক্রম মানবজাতিকে আবারো হয়ত দীর্ঘ মেয়াদে এক অজানা ‘স্পেস ওয়ার’ এর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।


 


 

সূত্র: ইউকীপিডিয়া, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, নাসা, গার্ডিয়ান, দ্য ইকোনোমিস্ট, স্পেস নিউজ, স্পেসডটকম।

 

 

সিরাজুর রহমান, (Sherur Rahman), শিক্ষক ও লেখক, বিনগ্রাম উত্তরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com

Comments

Popular posts from this blog

ইএল ক্যাপ্টেন' এক অবিশ্বাস্য দ্রুত গতির সুপার কম্পিউটার!

এক লিজেন্ডারী যুদ্ধবিমান এফ-১৪ টমক্যাট ফাইটার জেটঃ

Brain-Computer Interface (BCI) technology: