ভবিষ্যতের জ্বালানি নিরাপত্তায় মোবাইল নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের বিপ্লব!

বর্তমান বিশ্বের দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি, যুদ্ধসংক্রান্ত অনিশ্চয়তা এবং জলবায়ু সংকটের প্রেক্ষাপটে নিরাপদ, স্বল্প ব্যয়, পরিবহনযোগ্য ও নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এই প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ক্ষুদ্র আকারের ভ্রাম্যমাণ নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট প্রযুক্তি, অর্থাৎ মোবাইল মাইক্রো নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর (MMNR) প্রযুক্তি উন্নয়নে জোর দিয়েছে। এই চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে উন্নত বিশ্বের প্রযুক্তিবিদরা উদ্ভাবন করেছেন মোবাইল মাইক্রো নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর (Mobile Micro Nuclear Reactor – MMNR) প্রযুক্তি। এটি এমন একটি ভবিষ্যতনির্ভর শক্তি উৎপাদন ব্যবস্থা, যা যেকোনো সংকটময় পরিস্থিতিতে টেকসই ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে মনে করা হয়। যদিও এই প্রযুক্তি এখনো পর্যন্ত গবেষণা ও উন্নয়নের প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। মোবাইল মাইক্রো নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর টেকনোলজি হলো একটি ক্ষুদ্রাকৃতির, পরিবহনযোগ্য ও স্বয়ংসম্পূর্ণ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা। এই ধরনের রিঅ্যাক্টর সাধারণত প্রায় ১ থেকে ২০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম এবং এটি একটানা হয়ত প্রায় ৮-১০ বছর পর্যন্ত কোন রিফুয়েলিং ছাড়াই চালানো সম্ভব হবে। নতুন প্রজন্মের এই নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হচ্ছে যেন তা ট্রাক, ট্রেইলার, কনটেইনার বা হেলিকপ্টারে বহনযোগ্য হয় এবং দ্রুত মোতায়ে্ন করা যেতে পারে। নতুন উদ্ভাবিত এই প্রযুক্তিতে গ্যাস-কুলড, লিকুইড-মেটাল কুলড কিংবা লিড-কুলড ধরনের অত্যাধুনিক কুলিং সিস্টেম ব্যবহৃত হয়। যা কোন ঝুঁকি ছাড়াই উচ্চ নিরাপত্তা, জ্বালানি দক্ষতা ও পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারে। এতে থাকা স্বয়ংক্রিয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও দীর্ঘমেয়াদী ফুয়েল সাইকেল ব্যবস্থাপনা এই সিস্টেমটিকে যুদ্ধ কিংবা যে কোন সংকটময় পরিস্থিতিতে হয়ত আরও কার্যকর ব্যবহারের সুযোগ এনে দিতে পারে। গত ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর একটি উচ্চাভিলাষী প্রকল্প “Project Pele” চালু করে। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল একটি ১–৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন মাইক্রো নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর তৈরি করা, যা যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশে দ্রুত মোতায়েন করা যাবে। এ প্রকল্পে ইতোমধ্যেই প্রায় ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অধিক অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। আমেরিকা ভিত্তিক BWX Technologies এবং X-energy নামক দুই মার্কিন কোম্পানি এতে heat pipe-cooled fast reactor প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে নতুন প্রজন্মের নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর ডিজাইন জমা দিয়েছে, যা তরল কুল্যান্ট ছাড়াই কাজ করতে সক্ষম। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি ২০২৫ সালের মধ্যেই হয়ত এই প্রযুক্তির প্রোটোটাইপ ব্যবহারের উপযোগী অবস্থায় পৌঁছাতে পারবে। এই প্রকল্পের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহার নিশ্চিত করা। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যতে এটি বেসামরিক বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। বিশেষ করে ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিত, দুর্যোগপীড়িত, বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন বা দুর্গম এলাকায় খুদ দ্রুত এবং নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে হয়ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি জাপানের মিতসুবিশি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ নিজস্ব মোবাইল নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর প্রযুক্তি উন্নয়নে ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে এবং তারা আগামী ২০৩০ সালের মধ্যেই পরীক্ষামূলক রিঅ্যাক্টর চালুর ব্যাপারে প্রবলভাবে আশাবাদী। অপরদিকে চীন “small modular reactor (SMR)” এবং “marine floating reactor” প্রকল্পতে বিনিয়োগ এবং গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। চীনের এসব উচ্চপ্রযুক্তির প্রকল্প মূলত সামরিক খাতে ব্যবহারে মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে ধারনা করা হয়। তাছাড়া রাশিয়া কিন্তু ইতোমধ্যেই “Akademik Lomonosov” নামে একটি ভ্রাম্যমাণ পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্লান্ট আর্কটিক অঞ্চলে মোতায়েন করেছে, তবে এটি তুলনামূলকভাবে অনেকটাই ভারী এবং বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছে। নতুন প্রজন্মের মোবাইল মাইক্রো নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর টেকনোলজি বিশেষ করে যুদ্ধকালীন সময়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহাকাশ মিশন বা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন অঞ্চলে সেনা ঘাঁটি, হাসপাতাল, রাডার বা স্থাপনায় জরুরি এবং নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করার মাধ্যমে এই প্রযুক্তি ‘energy resilience’ বা জ্বালানি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে। এতে শুধু নিরাপদ বিদ্যুৎ সরবরাহ নয়, বরং একটি দেশের কৌশলগত ও সামরিক সক্ষমতাও বৃদ্ধি করতে পারে। মোবাইল মাইক্রো নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে একবিংশ শতাব্দীর জ্বালানি বিপ্লবের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। এটি কেবল প্রযুক্তিগত পরীক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং যুদ্ধ, দুর্যোগ ও জ্বালানি নিরাপত্তায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার কৌশলগত অস্ত্রে পরিণত হতে চলেছে। বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণে এটি এখন একটি বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। পরিশেষে বলা যায়, নতুন এই অভাবনীয় প্রকল্প যে কেবল একটি প্রযুক্তিগত পরীক্ষা নয়, বরং এটি ভবিষ্যতের যুদ্ধ, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং দুর্যোগ মোকাবেলায় একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হতে পারে। আর আমেরিকার পাশাপাশি চীন, রাশিয়া এবং জাপানের মতো দেশগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ এই প্রযুক্তিকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। তাই মাইক্রো নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর প্রযুক্তি আগামী দশকে হয়তো সামরিক ও বেসামরিক উভয়ই ক্ষেত্রে টেকসই বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে বলে আশা করা যায়। তথ্যসূত্র বা রেফারেন্স তালিকা (সংক্ষেপে): 1. U.S. Department of Defense – Project Pele 2. BWXT – Micro Reactor Technology 3. World Nuclear Association – SMR Overview 4. Wikipedia – Mobile Microreactor 5. U.S. Department of Energy – Office of Nuclear Energy 6. International Atomic Energy Agency (IAEA) – SMR Report লেখক পরিচিতি: সিরাজুর রহমান সহকারী শিক্ষক ও প্রযুক্তিবিষয়ক লেখক বিনগ্রাম উত্তরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। ইমেইল: sherazbd@gmail.com

Comments

Popular posts from this blog

ইএল ক্যাপ্টেন' এক অবিশ্বাস্য দ্রুত গতির সুপার কম্পিউটার!

Brain-Computer Interface (BCI) technology: