নব্বইয়ের দশকে দক্ষিণ কোরিয়ার অটোনোমাস কার প্রযুক্তির উত্থান ও তার স্বপ্নভঙ্গ!

আজ থেকে প্রায় ৩২ বছর আগে, ১৯৯৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার কিয়ংপুক ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হান মিন-হং ও তাঁর গবেষক দল কয়েক বছরের প্রচেষ্টায় একটি ডেডিকেটেড অটোনোমাস ড্রাইভিং কার ডিজাইন ও তৈরি করেন, যা চালকের সক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই ব্যস্ত সড়কে নিরাপদে চলতে সক্ষম ছিল। পরীক্ষামূলক চালনায় এই স্বয়ংক্রিয় কার সিউল ও আশপাশের মহাসড়ক এবং জনাকীর্ণ রাস্তায় আনুমানিক ৩০০ কিলোমিটার পথ কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই অতিক্রম করে প্রযুক্তি মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। উচ্চ প্রযুক্তির এই অটোনোমাস গাড়িটিতে তৎকালীন সময়ে রাডার সেন্সর, ভিডিও ক্যামেরা-ভিত্তিক কম্পিউটার ভিশন সিস্টেম, সীমিত ক্ষমতার জিপিএস নেভিগেশন এবং অনবোর্ড মাইক্রোপ্রসেসর-ভিত্তিক ড্রাইভিং কন্ট্রোল ইউনিট ব্যবহৃত হয়েছিল। এই সিস্টেম রোড লেন শনাক্তকরণ, আশপাশের গাড়ি ও প্রতিবন্ধক সনাক্তকরণ, স্বয়ংক্রিয় গতি নিয়ন্ত্রণ এবং প্রাথমিক পর্যায়ের অবস্ট্যাকল অ্যাভয়ডেন্স সক্ষমতা প্রদান করত। তৎকালীন সময়ের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার প্রেক্ষাপটে এটি ছিল অত্যন্ত উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ একটি স্বয়ংক্রিয়চালিত গাড়ি। এই প্রকল্প নব্বইয়ের দশকে অটোনোমাস অটোমোবাইল প্রযুক্তিতে বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। তবে বাস্তবে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ, স্পষ্ট পরিকল্পনা এবং ধারাবাহিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এর গবেষণা ও উন্নয়ন আর বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারেনি। দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার প্রাথমিকভাবে এই প্রকল্পে অর্থায়ন করলেও পরবর্তীতে একে ব্যয়বহুল ও স্বল্পমেয়াদে অপ্রয়োজনীয় মনে করে তহবিল সীমিত বা হয়ত একেবারেই বন্ধ করে দেয়। তাছাড়া সে সময়ে সরকারের প্রযুক্তি বিনিয়োগের মূল ফোকাস ছিল সেমিকন্ডাক্টর, জাহাজ নির্মাণ ও ইলেকট্রনিক্স নির্ভর প্রযুক্তি খাতে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অটোনোমাস কার প্রযুক্তির ক্ষেত্রে একবিংশ শতাব্দীর একেবারেই শুরু থেকেই বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে শুরু করে। বিশেষ করে আমেরিকার Tesla আজ থেকে ২২ বছর আগে ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দ্রুতই বৈদ্যুতিক ও চালকবিহীন গাড়ি ডিজাইন ও উৎপাদনে বিশেষ মনোযোগ দেয়। অন্যদিকে, ১৯৯৫ সালে চীনের BYD ব্যাটারি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও গত ২০০৩ সাল থেকে নিজস্ব প্রযুক্তির গাড়ি উৎপাদন শুরু করে। তাছাড়া পরবর্তী সময়ে ইলেকট্রিক (ইভি কার) ও সেমি-অটোনোমাস বা স্বয়ংক্রিয় গাড়ি উতপাদন ও সারা বিশ্বে রপ্তানি করে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করে নেয় চীন। নব্বইয়ের দশক থেকেই জাপান ও জার্মানি চালকবিহীন গাড়ির গবেষণায় বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ শুরু করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জার্মানি ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত Mercedes-Benz PROMETHEUS Project পরিচালনা করে, যা ইউরোপের অন্যতম উচ্চাভিলাষী অটোনোমাস ড্রাইভিং কার প্রকল্প ছিল। তবে সেই সময়ে সেন্সর, কম্পিউটিং ক্ষমতা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি পর্যাপ্ত উন্নত না থাকায় বা প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে পূর্ণাঙ্গ সেন্সরযুক্ত স্বয়ংক্রিয়চালিত বা অটোনোমাস প্রযুক্তির গাড়ি উৎপাদন করা এবং তা তা বাজারে আনা সম্ভব হয়নি। অথচ দক্ষিণ কোরিয়ার অধ্যাপক হান মিন-হং-এর এই অটোনোমাস কার প্রজেক্ট বৈশ্বিক পর্যায়ের স্বচালিত অটোমোবাইল গবেষণার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করলেও, বাস্তবে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, পরিকল্পনা এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তা আর কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। (তথ্য ও ছবি সংগৃহীত) Sherazur Rahman sherazbd@gmail.com

Comments

Popular posts from this blog

ইএল ক্যাপ্টেন' এক অবিশ্বাস্য দ্রুত গতির সুপার কম্পিউটার!

ভবিষ্যতের জ্বালানি নিরাপত্তায় মোবাইল নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের বিপ্লব!

চীন কিভাবে তার বিদ্যুৎ শক্তিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ারে পরিণত করল?