রেয়ার আর্থ এলিমেন্ট: আধুনিক প্রযুক্তির এক অপরিহার্য উপাদান!
বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য উপাদান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস (Rare Earth Elements) বা রেয়ার আর্থ মেটাল। এই উপাদানের নামের মধ্যে “রেয়ার বা বিরল” কথাটি থাকলেও প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠে এসব উপাদান তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়।
তবে এই উপাদানগুলো প্রকৃতিতে খুব কম ঘনত্বে অন্য খনিজ বা মৌলের সাথে মিশ্রিত অবস্থায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। যার ফলে সেগুলো আহরণ, উত্তোলন ও পরিশোধন করা প্রযুক্তিগতভাবে যথেষ্ট জটিল এবং ব্যয়বহুল কাজ হয়ে থাকে।
বৈজ্ঞানিকভাবে রেয়ার আর্থ এলিমেন্ট বলতে পর্যায় সারণির ল্যান্থানাইড সিরিজের ১৫টি মৌল, এর সাথে স্ক্যান্ডিয়াম ও ইট্রিয়াম মিলিয়ে মোট ১৭টি মৌলকে বোঝানো হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ল্যান্থানাম, সেরিয়াম, প্রাসিওডিমিয়াম, নিওডিমিয়াম, প্রমেথিয়াম, সামারিয়াম, ইউরোপিয়াম, গ্যাডোলিনিয়াম, টার্বিয়াম, ডিসপ্রোসিয়াম, হোলমিয়াম, ইরবিয়াম, থুলিয়াম, ইটারবিয়াম, লুটেশিয়াম, স্ক্যান্ডিয়াম এবং ইট্রিয়াম।
বিরল মৃত্তিকা উপাদানের বিশেষ ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য, যেমন- চৌম্বকত্ব, বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা, তাপ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং আলোক বিকিরণ ক্ষমতা তাদেরকে উন্নত প্রযুক্তি পণ্যের জন্য অপরিহার্য করে তুলেছে। উদাহরণস্বরূপ, নিওডিমিয়াম ইলেকট্রিক গাড়ির মোটর ও উইন্ড টারবাইনের শক্তিশালী চুম্বকে ব্যবহৃত হয়। ইউরোপিয়াম স্মার্টফোন স্ক্রিন ও LED বাল্বের রঙিন পিক্সেল তৈরিতে অপরিহার্য। সেরিয়াম গাড়ির ক্যাটালিটিক কনভার্টারে বায়ুদূষণ কমায়।
এই উপাদানগুলো দেখতে অনেকটা চকচকে ধাতব এবং রসায়নগতভাবে মিল থাকলেও এদের ব্যবহার ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস খনি থেকে উত্তোলনের সময় থোরিয়াম ও ইউরেনিয়াম মিশ্রিত রেডিওঅ্যাকটিভ বর্জ্য সৃষ্টি হয়, যা পরিবেশের জন্য গুরুতর হুমকি তৈরি করে। তবুও চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো পরিবেশগত ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও এসব উপাদান উৎপাদন ও পরিশোধনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যাচ্ছে।
২০২৫ সালের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায় যে, রেয়ার আর্থ এলিমেন্টের বেশি রিজার্ভ রয়েছে চীনে (৪৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন)। এরপর ভিয়েতনাম (২২ মিলিয়ন), ব্রাজিল ও রাশিয়া (প্রতিটি ২১ মিলিয়ন), ভারত (৬.৯ মিলিয়ন, সাথে অন্ধ্র প্রদেশে নব-আবিষ্কৃত আনুমানিক ৭.২৩ মিলিয়ন টন মজুত যুক্ত হতে যাচ্ছে), অস্ট্রেলিয়া (৪.২ মিলিয়ন) এবং যুক্তরাষ্ট্রে (২.৩ মিলিয়ন)। অন্যান্য দেশ মিলিয়ে আরও ৮–১০ মিলিয়ন মেট্রিক টনের বিশাল মজুত রয়েছে।
চীন বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৬০–৭০% রেয়ার আর্থ উৎপাদন এবং ৮৫–৯০% প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যা বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের প্রায় ৮০% এর কাছাকাছি হতে পারে। তাছাড়া গত ২০২৪ সালে এর আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য ছিল প্রায় ৮.৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০৩২ সালে ১৯.৬২ বিলিয়নে পৌঁছে যেতে পারে।
গত তিন দশকে চীন এই খাতে পূর্ণাঙ্গ সাপ্লাই চেইন তৈরি করেছে এবং ২০২৩ সাল থেকে রপ্তানি সীমিতকরণ বা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে প্রযুক্তি বাজারে নিজের প্রভাব বজায় রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র বিকল্প উৎস খুঁজতে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করছে এবং দেশীয় খনি (যেমন ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেন পাস) পুনরায় চালু করছে।
ইউরোপীয় দেশগুলোও EU-এর Critical Raw Materials Act বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই বিরল উপাদানের সরবরাহ নিরাপদ রাখতে কাজ করছে। বিশেষ করে প্রযুক্তিনির্ভর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো এই উপাদানের জন্য এখনো পর্যন্ত অনেকটাই চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে রয়েছে।
তাছাড়া উচ্চ প্রযুক্তি পণ্য যেমন- স্মার্টফোন, ব্যাটারি, ইলেকট্রিক গাড়ি, এয়ারক্রাফট এবং ডিফেন্স টেকনোলজিতে ব্যবহৃত এসব উপাদানের জন্য চীনের একচেটিয়া বাজার পশ্চিমা বিশ্বের জন্য এক ধরনের কৌশলগত দুর্বলতা তৈরি করেছে বলে মনে করা হয়।
সর্বোপরি বলা যায়, রেয়ার আর্থ এলিমেন্ট এখন শুধু প্রযুক্তিগত উন্নয়নের নয়, বরং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও ভূরাজনীতির অন্যতম কৌশলগত সম্পদে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে এই বিরল উপাদান উত্তোলন, ব্যবহার ও বণ্টনে পরিবেশবান্ধব নীতি, স্বচ্ছতা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য হয়ে দেখা দিয়েছে। যাতে বৈশ্বিক প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং বিশেষ করে পরিবেশের ভারসাম্য সুরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়।
(তথ্য ও ছবি সংগৃহীত)
সংক্ষিপ্ত তথ্যসূত্র:
1. US Geological Survey – Mineral Commodity Summaries: Rare Earths (2025)
2. Data Bridge Market Research
3. Reuters
4. Wikipedia
Sherazur Rahman
sherazbd@gmail.com
Comments
Post a Comment