আধুনিক প্রযুক্তির এক অপরিহার্য উপাদান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে রেয়ার আর্থ মেটাল!

লেখক: সিরাজুর রহমান প্রকৃতিতে প্রাপ্ত রেয়ার আর্থ মেটাল বা উপাদান হচ্ছে, এমন কিছু একাধিক খনিজ বা মৌল যা বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি ও উৎপাদন শিল্পে অবিচ্ছেদ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই মৌলগুলোকে "rare" বা দুর্লভ বলা হলেও, প্রকৃতপক্ষে এই উপাদানগুলো পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠে মোটামুটি পরিমাণে মজুত রয়েছে। তবে এগুলো সাধারণত একাধিক অন্য খনিজ বা মৌলের সাথে মিশ্রিত অবস্থায় ছড়িয়ে থাকে। প্রকৃতিতে এটা বিশুদ্ধভাবে পাওয়া কঠিন হওয়ায় এর উত্তোলন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ অনেকটাই ব্যয়বহুল ও জটিল হয়ে থাকে। বিজ্ঞানের ভাষায় রেয়ার আর্থ মেটাল বা বিরল মৃত্তিকা উপাদান বলতে মূলত পর্যায় সারণির ল্যান্থানাইড সিরিজভুক্ত ১৫টি মৌল এবং স্ক্যান্ডিয়াম (Scandium) ও ইট্রিয়াম (Yttrium) নামের অতিরিক্ত ২টি মৌলকে বোঝায়। অর্থাৎ প্রকৃতিতে প্রাপ্ত মোট ১৭টি মৌলকে একত্রে রেয়ার আর্থ ম্যাটারিয়াল বা এলিমেন্টস বলা হয়। এদের মধ্যে রয়েছে ল্যান্থানাম (Lanthanum), সেরিয়াম (Cerium), প্রাসিওডিমিয়াম (Praseodymium), নিওডিমিয়াম (Neodymium), প্রমেথিয়াম (Promethium), সামারিয়াম (Samarium), ইউরোপিয়াম (Europium), গ্যাডোলিনিয়াম (Gadolinium), টার্বিয়াম (Terbium), ডিসপ্রোসিয়াম (Dysprosium), হোলমিয়াম (Holmium), ইরবিয়াম (Erbium), থুলিয়াম (Thulium), ইটারবিয়াম (Ytterbium), লুটেশিয়াম (Lutetium), স্ক্যান্ডিয়াম (Scandium) এবং ইট্রিয়াম (Yttrium) মৌল। এসব মৌলের বেশিরভাগই দেখতে চকচকে ধাতব রঙের এবং রসায়নগত গঠনে অনেকটা একরকম হলেও এদের ব্যবহার ও বৈশিষ্ট্য অনেকটাই ভিন্ন হয়ে থাকে। এই মৌলগুলোর অনেকগুলোই হাই-টেক ডিভাইস যেমন স্মার্টফোন, শক্তিশালী চুম্বক, ইলেকট্রিক গাড়ির মোটর, উইন্ড টারবাইন, সামরিক রাডার, যুদ্ধবিমান ও গাইডেড মিসাইল তৈরিতে অপরিহার্য উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে এখানে প্রকাশ থাকে যে, রেয়ার আর্থ উপাদান উত্তোলনে চরম মাত্রায় রেডিওঅ্যাকটিভ বর্জ্য (থোরিয়াম, ইউরেনিয়াম মিশ্রিত) সৃষ্টি হয় এবং তা পরিবেশে মিশে গিয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। চলতি ২০২৫ সালের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, রেয়ার আর্থ মেটাল বা বিরল মৃত্তিকা উপাদানের সবচেয়ে বড় রিজার্ভধারী দেশ হচ্ছে চীন। দেশটির কাছে আনুমানিক মজুতের পরিমাণ হতে পারে ৪৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন। এরপরেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ভিয়েতনামে রয়েছে প্রায় ২২ মিলিয়ন টন। আবার ব্রাজিল এবং রাশিয়ার কাছে রেয়ার আর্থ মেটালের মজুদ থাকতে পারে যথাক্রমে প্রায় ২১ ও ১৯ মিলিয়ন টন করে। ভারতেও রয়েছে এই দূর্লভ খনিজ মৌলের ৬.৯ মিলিয়ন টনের বিশাল ভান্ডার। আর অতি সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের আলুরু অঞ্চলে নতুন করে আবিষ্কৃত হয়েছে আনুমানিক ৭.২৩ মিলিয়ন টন রেয়ার আর্থ মেটাল/এলিমেন্টস (Rare Earth Elements - REEs)। অনুমান করা হচ্ছে, ভারতের মাটির তলে লুকিয়ে থাকা এই অতি মূল্যবান খনিজ পদার্থের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য হতে পারে আনুমানিক ৩৫০-৩৬০ বিলিয়ন ডলার। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের এই রিজার্ভ এখনো অনুসন্ধান ও গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং Geological Survey of India (GSI)-এর প্রাথমিক দাবির ভিত্তিতে এটা অনুমান করা হয়েছে। তবে GSI-এর প্রাথমিক সমীক্ষা অনুযায়ী, এই মজুদ ভারতকে রেয়ার আর্থ মেটালে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সাহায্য করবে বলে আশা করা যায়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার রিজার্ভ প্রায় ৪.২ মিলিয়ন টন এবং যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে আনুমানিক ২.৩ মিলিয়ন টন রেয়ার আর্থ উপাদানের মজুত রয়েছে। এছাড়া গ্রিনল্যান্ড, কানাডা, মায়ানমারসহ আরও কিছু দেশে সব মিলিয়ে আনুমানিক ৮ থেকে ১০ মিলিয়ন মেট্রিক টন রেয়ার আর্থ উপাদানের মজুদ রয়েছে। এই তথ্যগুলো বিশ্বে রেয়ার আর্থ উপাদান সরবরাহ এবং কৌশলগত খনিজ সম্পদের উপর দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। ২০২৫ সালের হিসেব অনুযায়ী, চীন রেয়ার আর্থ উপাদান (Rare Earth Metal) উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনে এখনও প্রধান নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে নিজের শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। বিশ্বে চীনের মোট রিজার্ভ প্রায় ৪৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন, যা পৃথিবীর শুধু বৃহত্তম রিজার্ভ নয়, বরং চীন বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ রেয়ার আর্থ উপাদান নিজেই উৎপাদন করে। তার পাশাপাশি চীন আনুমানিক ৮৫-৯০ শতাংশ রেয়ার আর্থ মেটাল বা বিরল মৃত্তিকা উপাদান নিজেই পরিশোধন ও প্রক্রিয়াজাত সারা বিশ্বে রপ্তানি করে। মনে করা হয় দেশটি বর্তমানে এই দূর্লভ উপাদানের আন্তর্জাতিক রপ্তানি (গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন) বাণিজ্যের প্রায় ৮০% একাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ডাটা ব্রিজ মার্কেট রিসার্চ ওয়েবসাইটের দেয়া তথ্যমতে, গত ২০২৪ সালে রেয়ার আর্থ মেটালের আন্তর্জতিক বাজারের মূল্য ছিল আনুমানিক ৮.৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং তা আগামী ২০৩২ সালের মধ্যে হয়ত ১৯.৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। বিগত তিন দশক থেকে চীনের এই উপাদানের (মাইনিং থেকে ম্যাগনেট তৈরির) পুরো চেইন অত্যন্ত সুসংগঠিত এবং টেকসই করে গড়ে তোলা হয়েছে। বিশেষ করে চীনের শি জিং পিং সরকার এই খাতকে শক্তিশালী করতে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে এই উপাদান রপ্তানিতে নানান নিয়ন্ত্রণ আরোপের মাধ্যমে বৈশ্বিক প্রযুক্তি বাজারে নিজস্ব প্রভাব বজায় রাখতে চায় দেশটি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন তাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও জাতীয় নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে রেয়ার আর্থ রপ্তানিতে বিধিনিষেধ জোরদার করেছে। বিশেষ করে গত ২০২৩ সালে চীন রেয়ার আর্থ মেটালের রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যা বৈশ্বিক প্রযুক্তি শিল্পে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে আমেরিকা, জাপান ও EU-এর জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয়। বর্তমানে এই উপাদানের উতপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং রপ্তানি বাণিজ্যকে ঘিরে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক ধরনের কৌশলগত প্রতিযোগিতা ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিশেষ করে প্রযুক্তিনির্ভর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো এই উপাদানের জন্য এখনো পর্যন্ত অনেকটাই চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে রয়েছে। প্রযুক্তি পণ্য যেমন স্মার্টফোন, ব্যাটারি, ইলেকট্রিক গাড়ি, এয়ারক্রাফট এবং ডিফেন্স টেকনোলজিতে ব্যবহৃত এসব উপাদানের জন্য চীনের একচেটিয়া বাজার তাদের জন্য এক ধরনের কৌশলগত দুর্বলতা তৈরি করেছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র চীনের এই আধিপত্য থেকে বের হয়ে আসতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভিয়েতনাম ও আফ্রিকার কিছু দেশের সঙ্গে যৌথভাবে মাইনিং ও পরিশোধন প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে আমেরিকা। এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশের রেয়ার আর্থ মেটাল সমৃদ্ধ খনিগুলোর আধুনিকায়ন, পরিশোধন এবং রিসাইক্লিং প্রযুক্তির উন্নয়নে গবেষণা ও বিনিয়োগ জোরদার করেছে। তাছাড়া রেয়ার আর্থ মেটাল উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই তাদের Mountain Pass মাইন (ক্যালিফোর্নিয়া) খনি পুনরায় চালু করেছে এবং অস্ট্রেলিয়ার সাথে AUKUS চুক্তি-র মাধ্যমে রেয়ার আর্থ সাপ্লাই চেইন নিশ্চিত করতে চায়। অন্যদিকে নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষায় প্রভাবশালী ইউরোপীয় দেশগুলো EU-এর Critical Raw Materials Act বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। পরিশেষে বলা যায়, আধুনিক প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা ও টেকসই উন্নয়নের যুগে রেয়ার আর্থ মেটাল এখন উন্নত বিশ্বের কাছে একটি কৌশলগত সম্পদে পরিণত হয়েছে। তবে এর নিরাপদ উত্তোলন, পরিশোধন, ব্যবহার ও বণ্টনে বৈশ্বিক সহযোগিতা, স্বচ্ছতা এবং পরিবেশবান্ধব নীতিমালা অপরিহার্য হয়ে দেখা দিয়েছে। এটি এখন কেবল প্রযুক্তিগত উন্নয়ন কিংবা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নয়, পৃথিবীর পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষারও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দেখা দিয়েছে। তথ্যসূত্র: ডাটা ব্রিজ মার্কেট রিসার্চ, উইকিপিডিয়া, রয়েটার্স, সায়েন্স হিস্টোরি ইনিস্টিটিউট (তথ্য ও ছবি সংগৃহীত) লেখক পরিচিতি: সিরাজুর রহমান, শিক্ষক এবং লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com

Comments

Popular posts from this blog

ইএল ক্যাপ্টেন' এক অবিশ্বাস্য দ্রুত গতির সুপার কম্পিউটার!

ভবিষ্যতের জ্বালানি নিরাপত্তায় মোবাইল নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের বিপ্লব!

চীন কিভাবে তার বিদ্যুৎ শক্তিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ারে পরিণত করল?