চীন কিভাবে তার বিদ্যুৎ শক্তিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ারে পরিণত করল?
("বিদ্যুৎ শক্তিই আধুনিক বিশ্বের নতুন ‘শক্তি’ হয়ে উঠেছে")
বর্তমান বিশ্বে বিদ্যুৎ ব্যবহার নিয়ে একটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে—একটি দেশের জনসংখ্যা যত বেশি, তার বিদ্যুৎ চাহিদাও তত বেশি হবে। তবে বিষয়টি আংশিক সঠিক হলেও বাস্তবতা অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্ন হয়ে থাকে। আধুনিক অর্থনীতিতে বিদ্যুৎ চাহিদা নির্ধারণে জনসংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে একটি দেশের শিল্প উৎপাদন কাঠামো এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতি। যা মূলত নির্ভর করে দেশের সার্বিক বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সরবরাহ ব্যবস্থাপনার উপর।
বৈশ্বিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, চীন বর্তমানে এমন একটি আধুনিক এবং সুসংগঠিত উৎপাদননির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলেছে, যেখানে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ৭০% শিল্প খাতে ব্যবহৃত হয়। বাকি অংশের মধ্যে গৃহস্থালি খাতে প্রায় ১৪% এবং সেবা খাতে ১৬% ব্যবহার হয়। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়, একবিংশ শতাব্দির আধুনিক যুগে জনসংখ্যা নয়, বরং শিল্পায়নই হচ্ছে বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রধান নিয়ামক।
বিগত চার দশকে চীনের বিদ্যুৎ উৎপাদন, ব্যবহার ও চাহিদার বৃদ্ধি কেবল জনসংখ্যার কারণে নয়, বরং এটি ঘটেছে এক বিশাল শিল্পব্যবস্থা এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের এক অভাবনীয় বিকাশের মাধ্যমে। এর ফলেই আজ চীন বিদ্যুৎ উৎপাদন, সরবরাহ ও ব্যবহারে দিক দিয়ে বিশ্বের শীর্ষ দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। যদিও বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি এবং প্রযুক্তি সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে আমেরিকা তার যোগ্য স্থান প্রায় এক শতাব্দী ব্যাপী ধরে রেখেছে।
গত ২০২৪ সালে চীনের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল প্রায় ২,৯০০–৩,০০০ গিগাওয়াট (GW)। যা ছিল বিশ্বের মোট উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ৩৫%। আর দেশটির সর্বোচ্চ তাৎক্ষণিক বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল প্রায় ১,৬০০ গিগাওয়াট। তার পাশাপাশি গত ২০২৪ সালে চীনের বার্ষিক বিদ্যুৎ ব্যবহার আনুমানিক ৮,৭০০ টেরাওয়াট-আওয়ার (TWh) অতিক্রম করে, যা ছিল আসলে বৈশ্বিক ব্যবহারের প্রায় ৩১% এর কাছাকাছি।
এখানে প্রকাশ থাকে যে, গত ২০২৪ সালে চীন প্রথমবারের মতো মোট ইনস্টলড বিদ্যুৎ সক্ষমতার ক্ষেত্রে কয়লার তুলনায় নবায়নযোগ্য শক্তিতে (যেমন হাইড্রো, সৌর, বায়ু) ৫১% অতিক্রম করে। তবে মোট বাস্তব বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিক থেকে এখনো কয়লাই সর্বোচ্চ স্থান দখল করে রেখেছে। তবে চীন কিন্তু এখনো বৈশ্বিক পর্যায়ে ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণে শীর্ষে অবস্থান করছে।
চীন বর্তমানে দেশজুড়ে গড়ে ওঠা লক্ষ লক্ষ উৎপাদনশীল শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সাশ্রয়ী মূল্যে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করেছে। দেশটিতে বর্তমানে শিল্পখাতে বিদ্যুৎ প্রতি ইউনিট মাত্র ০.০৮ মার্কিন ডলার (বা তারও কম) মূল্যে সরবরাহ করা হয়, যার জন্য রয়েছে সরকারি বিশেষ সহায়তা বা ভর্তুকি ব্যবস্থা। আবার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিদ্যুতের জন্য ভিন্নমূল্য নীতি অনুসরণ করে শি জিনপিং সরকার, যাতে দেশে শিল্প বিকাশ ত্বরান্বিত এবং টেকসই হয়।
এর বিপরীতে দেখা যায়, গত ২০২৪ সালে ভারতের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৪৪৫–৪৫০ গিগাওয়াট, যেখানে বার্ষিক ব্যবহার ছিল ১,৭০০–১,৮০০ টেরাওয়াট-আওয়ার (TWh)। যদিও ভারতের জনসংখ্যা চীনের চেয়েও বেশি, তবুও বিদ্যুৎ ব্যবহারে এমন পার্থক্যের মূল কারণ হচ্ছে শিল্পায়নের মাত্রায় পার্থক্য।
অন্যদিকে ভারতে বিদ্যুতের আনুমানিক ৪২% শিল্প খাতে, এবং বাকি বড় অংশ কৃষি (প্রায় ১৫–২০%) ও গৃহস্থালি খাতে (প্রায় ২৫%) ব্যবহৃত হয়। তবে ভারত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে পরিকল্পিতভাবে অগ্রগতি করেছে। দেশটি শুধু গত ২০২৪ সালেই প্রায় ১৮ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। যা দেশটির জন্য একটি মাইলফলক অর্জন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
চীনে বিদ্যুৎ ব্যবহারের ৭০% এর বেশি ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, অটোমোবাইল, টেক্সটাইল, চিপ ও ইলেকট্রনিক্স উৎপাদন, হেভি মেশিনারি ইত্যাদি উচ্চ বিদ্যুৎনির্ভর খাতে ব্যয় হয়। তুলনামূলকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে শিল্পখাতে বিদ্যুৎ ব্যবহার গড়ে ৩৫–৪৫%। এতে বোঝা যায়, চীন শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনে নয়, বিদ্যুৎনির্ভর শিল্প ব্যবস্থার দক্ষ ব্যবহারে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে। যা বাংলাদেশের মতো স্বল্প আয়ের দেশের শিল্প উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সরবরাহ এবং ব্যবস্থাপনায় একটি মডেল হিসেবে দেখা যেতে পারে।
চীন দীর্ঘ পরিকল্পনার মাধ্যমে একটি “Massive Manufacturing Ecosystem” গড়ে তুলেছে। এই ecosystem-এর ভিত্তিতে আজ চীনকে বলা হয় “বিশ্বের কারখানা (Factory Hub)”। পৃথিবীর অধিকাংশ মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, সৌর প্যানেল, হোম অ্যাপ্লায়েন্স এবং ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ এখন চীনে তৈরি হয়। দেশটি তার নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার শীর্ষে উঠে এসেছে।
বর্তমানে চীন EV (Electric Vehicle), ব্যাটারি প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চিপ (AI Chips) এবং সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তিতে বৈশ্বিক নেতৃত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও AI চিপ ও সেমিকন্ডাক্টরের ক্ষেত্রে এখনো যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান প্রভাবশালী অবস্থানে রয়েছে, তবুও চীনের রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ও বিদ্যুৎ-নির্ভর অবকাঠামো দেশটিকে এই খাতে দ্রুত শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে।
চীনের এই শিল্প-শক্তির প্রভাব শুধু দেশের ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়—এটি বৈশ্বিক রপ্তানি বাজারে দৃশ্যমান। ২০২৪ সালে চীন প্রায় ৯২৭.৬ বিলিয়ন ডলারের ইলেকট্রনিক্স, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, টেলিকম এবং প্রযুক্তিপণ্য রপ্তানি করেছে (সূত্র: UN Comtrade, China Customs)। এটি বৈশ্বিক রপ্তানি আয়ের দিক থেকে সর্বোচ্চ আয়।
সেই তুলনায়, যুক্তরাষ্ট্র একই বছরে আনুমানিক ৪৪০–৪৫০ বিলিয়ন ডলারের উচ্চ প্রযুক্তি পণ্য রপ্তানি করেছে (বিমান প্রযুক্তি, চিকিৎসা যন্ত্র, চিপ ইত্যাদি)। অথচ একই সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার এক উদীয়মান অর্থনিতির দেশ হিসেবে ভারতের প্রযুক্তি পণ্য রপ্তানি ছিল প্রায় ৩৮.৫৮ বিলিয়ন ডলার—যার বেশিরভাগই মোবাইল ফোন, টিভি, সার্কিট বোর্ড ও প্রযুক্তি উপাদানভিত্তিক।
চীন বিদ্যুৎকে শুধু একটি জ্বালানি হিসেবে দেখেনি, বরং এটিকে একটি কৌশলগত শিল্প-অস্ত্রে পরিণত করেছে। যেসব দেশ আগামী দশকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দিতে চায়, তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প ব্যবহার ও প্রযুক্তি বিকাশের সমন্বিত নীতি গ্রহণ করা জরুরি। আর তাই বাংলাদেশের টেকসই শিল্পায়ন এবং রপ্তানি সক্ষমতা বৃদ্ধিতে নিরবিচ্ছিন্ন ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং শিল্পখাতকেন্দ্রিক বিদ্যুৎ নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে চীনের অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য পথপ্রদর্শক হতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, শিল্পনির্ভর বিদ্যুৎ ব্যবহার এবং উৎপাদনের দক্ষতা যেসব দেশের রয়েছে, তারাই বর্তমানে রপ্তানি, প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক নেতৃত্বে এগিয়ে রয়েছে। ভবিষ্যতের বিশ্বে বিদ্যুৎ-নির্ভর শিল্পই হবে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বিজয়ের মূল ভিত্তি। আর এক্ষেত্রে চীন হচ্ছে সবচেয়ে সফল উদাহরণ। এবং একথা আজ অবশ্যম্ভাবী সত্য যে, বিদ্যুৎ শক্তিই আধুনিক বিশ্বের নতুন ‘শক্তি’ হয়ে উঠেছে।
লেখক পরিচিতি:
সিরাজুর রহমান
শিক্ষক ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিষয়ক লেখক
সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ।
sherazbd@gmail.com
তথ্যসূত্র:
1. China Electricity Council (2024). Annual Power Report (cec.org.cn)
2. IEA (2024). World Energy Outlook (iea.org)
3. UN Comtrade Database (2024). Electronics Export Data
4. China Customs, Indian Ministry of Commerce, ICEA
নোট:
“এই প্রবন্ধটি (এআই) টুল-এর সহায়তায় সম্পাদনা ও পরিমার্জন করা হয়েছে। যাতে এর ভাষাগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, তথ্য উপস্থাপনা এবং আন্তর্জাতিক পাঠকদের জন্য পাঠযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়।"
Comments
Post a Comment