মাত্র এক ইউরো প্রতীকী মূল্যে ১৮টি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান রোমানিয়াকে উপহার দিল নেদারল্যান্ডস!
লেখক: সিরাজুর রহমান
সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ন্যাটো জোটের প্রশিক্ষণ কৌশলের অংশ হিসেবে নেদারল্যান্ডস প্রতীকী এক ইউরো মূল্যে রোমানিয়ার কাছে ১৮টি পুরনো এফ-১৬ যুদ্ধবিমান হস্তান্তর করেছে। মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর পাইলটদের যুদ্ধবিমান পরিচালনায় দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে রোমানিয়া প্রায় ৩৫টি পুরনো এফ-১৬ যুদ্ধবিমান পরিচালনা করছে, যা ন্যাটো স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এই যুদ্ধবিমানগুলো রোমানিয়ায় অবস্থিত একটি আন্তর্জাতিক ফাইটার ট্রেনিং সেন্টারে ব্যবহৃত হবে। এখানেই ইউক্রেনসহ অন্যান্য মিত্র দেশের পাইলটদের যুদ্ধবিমান উড্ডয়ন, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাছাড়া ইউক্রেনীয় পাইলটদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বিমানগুলোর আধুনিকায়ন ও অস্ত্রসজ্জার ব্যয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তা তহবিল থেকে নির্বাহ করা হয়।
এদিকে ইউক্রেনের প্রায় পাইলট ও টেকনিক্যাল ক্রু ইতোমধ্যেই রোমানিয়ায় প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে নিজ দেশে ফিরে গিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আকাশযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন। এই এফ-১৬ যুদ্ধবিমানগুলোতে প্রয়োজনীয় মিসাইল ও অস্ত্র সরবরাহ করছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। আর চলমান যুদ্ধে এই যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ইউক্রেনে আকাশ পথে আগত অজানা সংখ্যক ব্যালেস্টিক মিসাইল ও কমব্যাট ড্রোন ধ্বংসের দাবি করে ইউক্রেন।
তবে রাশিয়ার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের অন্তত ৪টি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ধ্বংস করা হয়েছে। যদিও ইউক্রেন বা ন্যাটো এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু নিশ্চিত করেনি, এবং রাশিয়ান টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ধ্বংস সংক্রান্ত ভিডিওর সত্যতাও নিশ্চিতভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে যুদ্ধে বেশকিছু যুদ্ধবিমান ইতোমধ্যেই যে ধ্বংস হয়েছে সেটা এক রকম নিশ্চিত বলা চলে।
চলতি ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত ইউরোপের চারটি দেশ ইউক্রেনকে মোট ৮৫টি আধুনিকায়নকৃত এফ-১৬ যুদ্ধবিমান সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে নেদারল্যান্ডস ২৪টি, নরওয়ে ১২টি, ডেনমার্ক ১৯টি এবং বেলজিয়াম ৩০টি বিমান সরবরাহ করবে। তবে কৌশলগত কারণে ইউক্রেনকে এখন পর্যন্ত হস্তান্তরিত মোট বিমানের সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিন কর্পোরেশনের তৈরি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ১৯৭৮ সালে প্রথম সার্ভিসে যুক্ত হয়। বর্তমানে এটি বিশ্বের সবচেয়ে সফল সিঙ্গল ইঞ্জিন লাইট ফাইটার হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে। এর সর্বাধুনিক সংস্করণ এফ-১৬ভি ব্লক-৭০/৭২ সিরিজের প্রতিটি বিমান, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ প্যাকেজসহ প্রতিটি যুদ্ধবিমানের মূল্য আনুমানিক ১০০–১২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে পারে।
সিঙ্গেল ইঞ্জিন চালিত এই যুদ্ধবিমানে ব্যবহৃত হয় Pratt & Whitney F100-PW-229 অথবা GE F110-GE-129 আফটারবার্নিং টার্বোফ্যান ইঞ্জিন। এর প্রধান অস্ত্র হিসেবে AIM-120D AMRAAM, AIM-9 Sidewinder, AGM-88 HARM ও AGM-84 Harpoon এর মতো আধুনিক মিসাইল দ্বারা সজ্জিত করা হয়েছে।
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ২৫টি দেশ কার্যকরভাবে বিভিন্ন সিরিজের এফ-১৬ যুদ্ধবিমান পরিচালনা করে। সর্বোচ্চ প্রায় ৮৯৭টি বিমান পরিচালনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। তাছাড়া আমেরিকার পাশাপাশি তুরস্ক (২৪৩টি), ইসরায়েল (২২৪টি), মিশর (২১৮টি), দক্ষিণ কোরিয়া (১৬৭টি), গ্রীস (১৫৪টি), তাইওয়ান (১৩৭টি), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৭৬টি), পাকিস্তান (৭৫টি), জর্ডান (৫৯টি), সিঙ্গাপুর (৬০টি), বেলজিয়াম (৫৩টি), থাইল্যান্ড (৫০টি) যুদ্ধবিমান অপারেট করে।
অন্যদিকে পোল্যান্ড (৪৮টি), চিলি (৪৬টি), ডেনমার্ক (৪৩টি), ইরাক (৩৪টি), ইন্দোনেশিয়া (৩৩টি), নেদারল্যান্ডস (২৬টি), পর্তুগাল (২৫টি), ওমান ও মরক্কো (২৩টি করে), এবং ভেনেজুয়েলা (১৫টি) এফ-১৬ যুদ্ধবিমান অপারেট করে। যদিও তুরস্ক, বেলজিয়াম, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান নিজ দেশে এই বিমান সংযোজন করে। তবে এর মূল প্রযুক্তি এবং সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিন কর্পোরেশন নিজেই।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎস ও অপারেশনাল রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৭৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬৮৫টির মতো এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনা, যুদ্ধে ধ্বংস কিংবা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এ ধরনের ক্ষয়ক্ষতির হার এর ব্যবহারিক বিস্তৃতি ও দীর্ঘমেয়াদি সক্রিয়তার পরিপ্রেক্ষিতে তুলনামূলকভাবে সীমিতই বলা চলে। আর সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা বাজারে নতুন এফ-১৬ ক্রয়াদেশ আশি ও নব্বইয়ের দশকের তুলনায় অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে।
তবে এটা কিন্তু এফ-১৬ এর প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের কোন ঘাটতি নয়, বরং এটি ব্যবহারে জটিল শর্ত ও নীতিমালা, প্রযুক্তি হস্তান্তরে বাঁধা, কৌশলগত স্বাধীনতা এবং খরচ দক্ষতার মতো বিষয়গুলো দেশগুলোর যুদ্ধবিমান নির্বাচন প্রভাবিত করছে। তাই অনেক দেশ এখন এর বিকল্প হিসেবে চীনের J-10CE, দক্ষিণ কোরিয়ার FA-50, কিংবা সুইডেনের Saab Gripen যুদ্ধবিমান সংগ্রহের বিষয়টি বিবেচনা করছে। একাধিক সমালোচনা সত্ত্বেও এফ-১৬ আজও বিশ্বের অন্যতম বহুল ব্যবহৃত, টেকসই এবং কার্যকর যুদ্ধবিমান হিসেবে নিজের যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে।
(তথ্য ও ছবি সংগৃহীত)
তথ্যসূত্র: Reuters, Wikipedia, The War Zone, Kyiv Independent, Defense Industry Europe, Romania Insider, Defense Express
লেখক পরিচিতি:
সিরাজুর রহমান
শিক্ষক ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি লেখক
সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ
sherazbd@gmail.com
Comments
Post a Comment