দিল্লিতে বায়ুদূষণ কমাতে কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের উদ্যোগ!
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ভয়াবহ বায়ুদূষণ মোকাবিলায় কৃত্রিমভাবে বৃষ্টিপাত (Cloud Seeding) ঘটানোর লক্ষ্যে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর আওতায় ২০২৫ সালের ৪ থেকে ১১ জুলাইয়ের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কার্যক্রম পরিচালিত হবে। প্রথম পর্যায়ে দিল্লির আকাশে ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে আকাশে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানো হবে।
ভারতের এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো যে, বাতাসে ভাসমান অতিক্ষুদ্র ধূলিকণা যেমন PM2.5 এবং PM10 সহ অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদানগুলোকে কৃত্রিম বৃষ্টির মাধ্যমে ধুয়ে ফেলে বাতাসকে পরিশোধন করা। দিল্লির এই উদ্যোগ যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে আইআইটি কানপুর এবং ভারতের আবহাওয়া বিভাগ (IMD)।
ক্লাউড সিডিং বা কৃত্রিম বৃষ্টিপাত প্রযুক্তি আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণের একটি আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে বিমান বা ড্রোনের মাধ্যমে মেঘের মধ্যে সিলভার আয়োডাইডের মতো রাসায়নিক উপাদান ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এই উপাদান মেঘে উপস্থিত জলকণাগুলোর ঘনীভবন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে, যার ফলে মেঘ ভারী হয়ে বৃষ্টিপাত সৃষ্টি করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর তথ্য অনুযায়ী, দিল্লি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। শীতকাল এলে সেখানে বায়ুতে PM2.5-এর মাত্রা প্রায়ই ৪০০ µg/m³ ছাড়িয়ে যায়, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। এই অতিক্ষুদ্র কণাগুলো ফুসফুসের গভীরে প্রবেশ করে দীর্ঘমেয়াদে শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ এবং এমনকি ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করতে পারে।
PM বা Particulate Matter হল বাতাসে ভাসমান অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা। এর দুটি প্রধান ধরন হলো PM2.5 (ব্যাস ২.৫ মাইক্রোমিটারের কম) এবং PM10 (ব্যাস ১০ মাইক্রোমিটারের কম)। PM2.5 মানবদেহে বেশি ক্ষতিকর হয়ে থাকে। কারণ এটি ফুসফুস পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হয়, অন্যদিকে PM10 সাধারণত নাক ও শ্বাসনালীতে আটকে যায়।
WHO-এর নির্দেশিকা অনুযায়ী, PM2.5-এর বার্ষিক নিরাপদ গড় মাত্রা ৫ µg/m³ এবং ২৪ ঘণ্টার গড় ১৫ µg/m³। PM10-এর ক্ষেত্রেও বার্ষিক গড় ১৫ µg/m³ এবং ২৪ ঘণ্টার গড় ৪৫ µg/m³ নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ দিল্লি, ঢাকা এবং করাচির মতো ঘনবসতিপূর্ণ দক্ষিণ এশীয় শহরগুলোতে এই মাত্রা প্রায়শই ১০০ µg/m³ ছাড়িয়ে যায়, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের তুলনায় প্রায় ২০ গুণ বা তারও বেশি মাত্রায় ছাড়িয়ে যায়।
উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ ইতিমধ্যেই ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তির সফল প্রয়োগ করেছে। যেমন—চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE) এবং যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃত্রিমভাবে বৃষ্টিপাত ঘটিয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, চীন ২০২২ সালের বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিকের আগে রাজধানীর বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে এই প্রযুক্তির ব্যবহার করেছিল।
তবে গত ২০২৪ সালের এপ্রিলে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানোর জন্য ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তি ব্যবহারের পর হঠাৎ করেই অতিরিক্ত মাত্রায় বৃষ্টিপাত ঘটে। যার ফলে সারা নগরজুড়ে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা ও যানজটের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অথচ আধুনিক নগর ব্যবস্থাপনা থাকা সত্ত্বেও মাত্র ২৪ ঘণ্টার বৃষ্টিতে শহরের বিমানবন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে।
সমালোচকেরা অভিযোগ করেন, প্রকৃত আবহাওয়া বিশ্লেষণ না করেই অতিরিক্ত ক্লাউড সিডিং কার্যক্রম চালানো হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতে। যা প্রাকৃতিক ভারসাম্যে চরম বিঘ্ন সৃষ্টি করে এবং অতি বৃষ্টিপাতের ফলে ভয়াবহ দুর্যোগ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এ ঘটনা কৃত্রিম বৃষ্টিপাত প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করে।
ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তি অনেকের কাছে নতুন কোন বিষয় বলে মনে হলেও বাস্তবে এর ইতিহাস কিন্তু বেশ পুরনো। ১৯৪৬ সালের ২৯ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের Schroon Lake এলাকায় প্রথম সফলভাবে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানো হয়।
বিজ্ঞানী ভিনসেন্ট জে. শেফার (Vincent J. Schaefer) এবং নোবেলজয়ী গবেষক আর্বিং ল্যাংমুইর (Irving Langmuir) General Electric–এর গবেষণাগারে প্রথমে শীতল কক্ষে শুষ্ক বরফের মাধ্যমে বরফকণা তৈরি করেন। পরে বিমানের মাধ্যমে সেই বরফ মেঘের মধ্যে ছড়িয়ে প্রকৃত বৃষ্টিপাত ঘটানো হয়।
যদিও প্রযুক্তিটি কার্যকর বলে প্রমাণিত, তবুও এর দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশগত প্রভাব এবং অর্থনৈতিক কার্যকারিতা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক ও সমালোচনা এখনো বিদ্যমান রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন—শুধুমাত্র ক্লাউড সিডিংয়ের মাধ্যমে বায়ু দূষণ রোধ করা সম্ভব নয়।
আসলে পরিবেশ দূষণের মূল উৎস যেমন—শিল্পবর্জ্য, যানবাহনের ধোঁয়া, খোলা জায়গায় আবর্জনা পোড়ানো ইত্যাদি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে এটি শুধু সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে। তাই পরিবেশ দূষণের মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা রোধ করার চেষ্টা করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, দিল্লিতে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত প্রকল্প নিঃসন্দেহে একটি সাহসী, সময়োপযোগী এবং বিজ্ঞাননির্ভর উদ্যোগ। তবে এটি যেন পরিবেশ সুরক্ষার দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই সমাধানের পথে একটি মাইলফলক হয়ে ওঠে, সেই লক্ষ্যে আমাদের সম্মিলিতভাবে অগ্রসর হতে হবে।
তথ্যসূত্র:
WHO Air Quality Guidelines 2021, Hindustan Times, July 2025, India Today, NDTV Reports, GE Research Archives and UN Environment Programme
Sherazur Rahman
sherazbd@gmail.com
Comments
Post a Comment