বৈশ্বিক অস্ত্র বানিজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি এবং বাস্তবতা!

বৈশ্বিক অস্ত্র বানিজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি এবং বাস্তবতা!

দক্ষিণ চীন সাগরের মালিকানা নিয়ে সামরিক উত্তেজনা, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান সীমান্ত সংঘর্ষ এবং সর্বপরি মধ্যপ্রাচ্যে চরম অস্থিতিশীল এবং ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বব্যাপী ২০১৯ সালে সারা বছর ব্যাপী আনুমানিক ১২৩ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থের প্রাণঘাতী অস্ত্র এবং সামরিক সাজ সরঞ্জামের ব্যাপক বানিজ্য হয়েছে। যদিও বৈশ্বিক পর্যায়ের স্টোকহোম বেসড ইন্টারন্যাশনাল পীস রিসার্চ ইনিস্টিউট, ডিফেন্স জেন্স রিপোর্ট, গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার, বিজনেস ইনসাইডারসহ একাধিক ডিফেন্স থিংক ট্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে সারা বিশ্বে ৮০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি অস্ত্র বানিজ্য হয়েছে দেখানো হয়। তবে এ তথ্য উপাত্ত কিন্তু বাস্তবতার সাথে মোটেও সামাঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলেই প্রতিয়মান হয়। আর এই বিশাল অস্ত্র বাণিজ্যের মোট ৩৮% থেকে ৪৫% পর্যন্ত মূল ক্রেতা ছিল মধ্যপ্রাচ্যের বাদশা ও আমির শাসিত আরব দেশগুলো। তাছাড়া পাকিস্তান ও চীনের সাথে চরম বৈরি সম্পর্ক এবং বিবাদের জেরে ভারতকে প্রতি বছর জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার স্বার্থে বিপুল পরিমাণ ও মূল্যের যুদ্ধাস্ত্র এবং সামরিক সাজ সরঞ্জাম বিদেশ থাকে আমদানি করতে হচ্ছে। যা কিনা বৈশ্বিক অস্ত্র বাণিজ্যের শতকরার হিশেবে ১২% এর কাছাকাছি এবং তা কিন্তু সৌদি আরবের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমদানি কারক দেশ।

যেখানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অস্ত্র বাণিজ্য ২০১৮ সালে ছিল ৯৮ বিলিয়ন ডলার, ২০১৭ সালে ছিল ৮১ বিলিয়ন এবং ২০১৬ সালে ছিল ৭২ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৫ সালে এ অস্ত্র বাণিজ্য ছিল ৬৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। আসলে এখানে প্রদত্ত অস্ত্র বানিজ্যের তথ্য উপাত্ত যে আকেবারেই শতভাগ সঠিক হওয়ার কোন সুযোগ নেই। বিশেষ করে সারা বিশ্বে সক্রিয় থাকা অসংখ্য ছোট বড় গেরিলা কিম্বা জঙ্গি সংগঠন ও সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে থাকা ক্ষুদ্র যুদ্ধাস্ত্রে ৭০% পর্যন্ত মুল যোগানদার কিন্তু রাশিয়া এবং চীন। আর গোপনে করা এহেন অস্ত্র বানিজ্যে কি পরিমাণ অর্থ বানিজ্য হয় তার সঠিক কোন চিত্র কিম্বা তথ্য পাওয়ার কোন সুযোগ নেই।

আবার বিশ্ব অস্ত্র বানিজ্যের একটি বড় অংশ বিশ্বের দুই সামরিক পরাশক্তিধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাই ৩৫% এবং রাশিয়া ২৩% সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া বিশ্বের অন্যতম উদীয়মান অর্থনৈতিক এবং সামরিক পরাশক্তি চীন ৫%, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলো ২০% এবং এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষুদ্রতম দেশ ইসরাইল ২০১৯ সালে ৬.৫০ বিলিয়ন ডলার অস্ত্র রপ্তানি করে বিশ্ব অস্ত্র বানিজ্যের ২.৫% নিজ দখলে নিয়েছে। অবশ্য জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ব্রাজিলসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো মিলে বিশ্ব অস্ত্র বাণিজ্যের ১০% নিয়ন্ত্রণ করে। তবে ক্ষেত্র বিশেষে এ তথ্য উপাত্ত কিছুটা কম কিম্বা বেশি হতে পারে।

তবে অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সারা বিশ্বব্যাপী অস্থিতিশীল ও সংঘাতময় পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং তা বছরের পর বছর লাগামহীনভাবে চলমান রাখা এবং সারা বিশ্বব্যাপী যুদ্ধভাব বা নিজস্ব প্রভাব বজায় রাখাতে বিশ্বের অন্যতম প্রধান সামরিক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীনসহ গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত অস্ত্র উৎপাদনকারী দেশগুলো অতি উৎসাহী বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ বৈশ্বিক অস্ত্র বাণিজ্যের মূল সুবিধাভোগী কিন্তু এসব অস্ত্র উৎপাদনকারী দেশগুলো। আর বিশ্বব্যাপী সামরিক উত্তেজনা বা যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ না করলে বিশ্বের ধনী আরব দেশসহ অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো ব্যাপকভাবে অস্ত্র আমদানি করবে না বা অপ্রয়োজনে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে বিপুল পরিমাণ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে অস্ত্র কিনতে উৎসাহিত হবার কোন সুনির্দিষ্ট কারণ থাকতে পারে না। যেমন এখন সৌদি আরবের ভয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ছোট দেশ কাতার তার নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোড়দারে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নির্বিচারে ব্যয় করে যাচ্ছে এবং তাদের যুদ্ধাস্ত্র ক্রয়ের তালিকা বা ডিফেন্স ইকিউপমেন্ট মার্কেটিং লিস্ট দেখলে আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না।

তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব সমাজ ব্যবস্থায় অনেকটা স্থিতিশীলতা এবং যুদ্ধ মুক্ত বিশ্বশান্তি বিরাজ করবে বলে প্রত্যাশা করা হলেও বাস্তবে অনেকটা অকারণেই বা পরাশক্তি দেশগুলোর চরম মাত্রায় প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতি ১০ থেকে ১২ বছর পর পর মাঝারী বা বৃহৎ পরিসরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এবং অঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালিত হতে দেখা যায়। আবার সারা বছরব্যাপী বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ ও সংঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যা কিনা নিজস্ব অস্ত্র বিক্রির আশায় অনেকটা কৃত্রিমভাবেই সৃষ্টি করা যে হয়নি তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে কট্টর জঙ্গীগোষ্টি আইএস এর উৎখান, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এবং সর্বপরি রাশিয়া কতৃক ইউক্রেনে আগ্রাসন, দক্ষিণ চীন সাগর বিরোধের জেরে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ভয়াবহ মানবিক সংকট ও ভীতিজনক যদ্ধাবস্থা পরিস্থিতির বিরাজ করছে। এতে করে অপেক্ষাকৃত ধনী ও দুর্বল সামরিক রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজস্ব সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এবং তাদের জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার স্বার্থেই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে প্রাণঘাতী এবং ভংঙ্কর অস্ত্র ও সাজ সরঞ্জাম আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছে। এমনকী ২০১৫ সালে ইয়েমেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাজ্য একাই ৬.৫০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষুদ এবং মাঝারী যুদ্ধাস্ত্র সৌদি আরবের কাছে সরবরাহ করেছে। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি স্বার্থ রক্ষা করার জন্য মার্কিন সামরিক অভিযান পরিচালনা এবং সৌদি আরবে সেনা উপস্থিতি নিশ্চিত করার স্বার্থে প্রতি বছর সৌদি আরব সরকার গোপনে কি পরিমাণ অর্থ চাঁদাবাজি স্বরুপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রদান করে যাচ্ছে তার কোন সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সৌদি প্রশাসন ১.০০ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহযোগিতা এবং দেশে মার্কিন সেনার উপস্থিতির খরচের অংশ হিসেবে মার্কিন কোন ব্যাংকে পরিশোধ করেছে বলে খোদ মার্কিন প্রসেডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ফক্স নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রকাশ করেন। আর এ থেকে কিন্তু মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে কী পরিমান অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে তার কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যায়।
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com

Comments

Popular posts from this blog

এক লিজেন্ডারী যুদ্ধবিমান এফ-১৪ টমক্যাট ফাইটার জেটঃ

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার দ্রুত বাস্তবায়ন আর কত দূরে ?

এবার আমেরিকার এফ-১৬ যুদ্ধবিমান পেতে যাচ্ছে তুরস্কঃ