চলমান বৈশ্বিক অর্থনীতির মহামন্দার কবলে বিপর্যস্ত চীন ও ভারতের অর্থনীতিঃ

চলমান বৈশ্বিক অর্থনীতির মহামন্দার কবলে বিপর্যস্ত চীন ও ভারতের অর্থনীতিঃ

২০১৯ সালের একেবারে প্রথম দিক থেকেই ভারতের ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়ে চলতি ডিসেম্বরে এসে তার পরিমাণ সর্বকালের রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে। এ মুহুর্তে ভারতের ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ ডিসেম্বরের শেষের দিকে এসে ১.৭০ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেয়ে তা মোট ৪৫৪.৪৯ বিলিয়ন ডলারে পৌছে গেছে। যা বৈশ্বিক অর্থনীতির মহামন্দা চলাকালীন অবস্থায় ভারতের সমষ্টিক অর্থনীতির জন্য একটি ইতিবাচক দিক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ভারতের এই বিপুল পরিমাণে ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি এ রিজার্ভ নতুন শিল্প এবং কল-কারখানা স্থাপন ও সম্প্রসারণে বিনিয়োগের মাধম্যে নতুন কর্ম সংস্থান সৃষ্টি এবং তার পাশাপাশি রপ্তানি বৃদ্ধির উপায় নির্ধারণের উপর নির্ভর করবে দেশের ইতিবাচক এবং স্থিতশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ।

আসলে উন্নয়নশীল এবং রপ্তানি নির্ভর অর্থনৈতির দেশে হঠাত করে আমদানি কমে গেলে এবং নতুন করে শিল্প উন্নয়ন এবং স্থাপনের হার হ্রাস পেলে সেক্ষেত্রে সাময়িকভাবে ফরেন কারেন্সির পরিমাণ ও মজুত বেড়ে যেতে পারে। বিশেষ করে ভারত বিশ্বের সর্বোচ্চ পরিমাণে রেমিটেন্স প্রবাহ বিদ্যামান থাকায় তা প্রতি নিয়ত দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়ন বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। ২০১৬ সালের হিসেব অনুযায়ী ভারতের প্রবাসী কর্মীরা ৬২.৭০ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছিলেন। যা ২০১৭ সালে ছিল ৬৫.৩০ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৮ সালে তা সর্বোচভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ৭৯.০০ বিলিয়ন ডালারে পৌছে যায়। আর এই ব্যাপক আকারের রেমিট্যান্স প্রবাহ কার্যত দীর্ঘ দিন থেকেই ভারতের ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ বৃদ্ধিতে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। আর একক মাস হিসেবে জুলাই ২০১৯ এ সর্বোচ্চ ১৪.৬৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ রেমিট্যান্স আসে ভারতে।

অন্যদিকে, নভেম্বর ২০১৯ এ এসে ভারতের মোট রফতানি ০.৩% কমে মোট রফতানির পরিমাণ ছিল ২৬.০০ বিলিয়ন ডলার এবং তার বিপরীতে একই সময়ে নভেম্বর মাসে মোট আমদানির পরিমাণ ছিল ৩৮.১০ বিলিয়ন ডলার। অর্থ্যাত ভারতে রপ্তানি অপেক্ষা আমদানির পরিমাণ বেশি হচ্ছে। যা দেশটির বানিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে প্রতিয়মান হয়। চলতি অর্থবছরের শুরুতে ভারতের মোট রপ্তানি ৩৩০.০০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হতে পারে বলে প্রত্যাশা করা হলেও ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত মোট রপ্তানির পরিমাণ ২.২১% কমে তা ১৮৫.৯৯ বিলিয়ন ডলারে এসে দাড়িয়েছে। অন্যদিকে অবশ্য মোট আমদানির পরিমাণও কিন্তু ৮.৩৭% কমে ২৮০.৬৭ বিলিয়ন ডলারে পৌছেছে। যার ফলে ভারতের এই সময়ের মধ্যে বানিজ্য ঘাতটির পরিমাণ বা স্থিতি ৯৪.৭২ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। অবশ্য ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ভারতের মোট রপ্তানি ছিল ৩০৩.৫ বিলিয়ন ডলার এবং সর্বকালের সর্বোচ্চ রপ্তানির রেকর্ডটি হয়েছিল ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে ৩১৪.৪০ বিলিয়ন ডলার।

তাই যে কোন কারণে ভবিষ্যতে অভারসীজ ইনকাম বা রেমিট্যান্স প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হলে ফরেন কারেন্সি রিজার্ভের উপর ব্যাপক চাপ পড়তে বাধ্য। তাছাড়া ২০১৯ এ কিন্তু দেশের স্টক সার্বিক মার্কেটের প্রবনতা অত্যন্ত ঋনাত্বক অবস্থায় রয়েছে। তাছাড়া বৌদেশিক ঋনের স্থিতির পরিমাণ কিন্তু ২.৬৩% বৃদ্ধি পেয়ে তা বর্তমানে ৫৪৩.০০ বিলিয়ন ডলারে পৌছে গেছে। আর বৈদেশিওক ঋনের সুদের পরিমাণ যদি বার্ষিক মাত্র ৪% ধরা হয়, তাহলে ভারতকে প্রতি বছর ২০.০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি শুধুমাত্র ঋনের সুদ বাবদ সমপরিমাণ অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় বিভিন্ন দেশ এবং আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ একাধিক বৈশ্বিক ঋন প্রদানকারী সংস্থাকে পরিশোধ করতে হচ্ছে। যা কিন্তু একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশের জন্য অত্যন্ত চিন্তার একটি বিষয় এবং যা অবশ্যই ভারতের সমষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য মোটেও সুখবর নয়।

যদিও সাম্প্রতিক সময়ে চীন মার্কিন বানিজ্য যুদ্ধের প্রভাবে চীনের রপ্তানি নির্ভর বানিজ্যে মন্দাভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। চলতি ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে চীনের মোট বৈশ্বিক রপ্তানির পরিমান ছিল ২২১.৭০ বিলিয়ন ডলার এবং যা অক্টোবর মাসে ছিওল ২১২.৯০ বিলিয়ন ডলার। আর একক মাস হিসেবে চীন সর্বোচ্চ পরিমাণে ২৩১.৮০ বিলিয়ন ডলারের পন্য বিশ্বের প্রায় দুই শতাধিক দেশে রপ্তানি করেছে। তবে ২০১৮ সালের সেপ্টম্বরের তুলনায় চলতি ২০১৯ সালের সেপ্টম্বরে এসে চীন ৩.২০% কম রপ্তানি করেছে এবং একই সময়ে সার্বিক আমদানি কম হয়েছে ৫%। ২০১৮ সালে চীনের বার্ষিক জিডিপি ছিল ১৩.৬১ ট্রিলিয়ন ডলার এবং তা ২০১৯ এসে ১৪.৪১ ট্রিলিয়ন এ পৌছাতে পাড়ে। আবার জিডিপির হার ২০১৭ সালে ৬.৮% থাকলেও তা ২০১৯ এর শেষে ৬.১% বা তারও নিচে নেমে আসতে পারে। এদিকে চীনের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চলতি ২০১৯ সালের অক্টোবরে ৩.১০৫ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে নভেম্বর ২০১৯ এ কমে তা ৩.০৯৬ ট্রিলিয়ন ডলারে দাড়িয়েছে। অন্যদিকে, বলাই বাহুল্য বিশ্বের এক নম্বর সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক জিডিপির আকার ২১.০০ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।

আবার বার্ষিক জিডিপির আকার সুবিশাল ২.৯৩ ট্রিলিয়ন ডালারের হলেও ২০১৯ সালের সারা বছর ধরে শতকরা হারের হিসেবে তা কিন্তু মাত্র ৪.৫%-৫.৬% সীমার মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে রয়েছে এবং তা কিন্তু গত বছরের প্রত্যাশিত ৭% হারের চাইতে অনেক নিচেই অবস্থান করছে তাছাড়া দেশে বেকারত্বের হার এখন ৬.৯% এবং সারা ভারতে ২০১৮ সালে ৩ কোটি ৩০ লক্ষ কর্মক্ষম মানুষ কর্মহীন ছিল যা ২০১৯ সালের সেষে এসে তা আনুমানিক ৪ কোটিতে পৌছে গেছে।। তাই নতুন করে বিনিয়োগ এবং শিল্পাঞ্চল স্থাপন কিম্বা সম্প্রসারণ করে মোট রপ্তানির পরিমাণ যে কোন মূল্যে বৃদ্ধি করতে হবে এবং পাশাপাশি দেশে ধারাবাহিকভাবে প্রতি বছর ব্যাপক আকারের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিকল্প কিছু থাকতে পারে বলে মনে হয় না। তাই এটা স্পষ্ট যে, ভারতের মোদি সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতির উচ্চ হার রাখা বা দেখানো এবং ব্যাপক প্রচারের বিষয়টিকে অনেকটাই নিজ সরকারের সুনাম বৃদ্ধি কিম্বা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অন্যতম কৌশল বলে মনে করা হচ্ছে।
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com

Comments

Popular posts from this blog

ইএল ক্যাপ্টেন' এক অবিশ্বাস্য দ্রুত গতির সুপার কম্পিউটার!

এক লিজেন্ডারী যুদ্ধবিমান এফ-১৪ টমক্যাট ফাইটার জেটঃ

Brain-Computer Interface (BCI) technology: