ভারতের বর্তমান ও ভবিষ্যত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা !
একুশ শতকের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং জাতীয় আকাশ নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করার স্বার্থে এবং বিশ্ব
মানের বিমান বাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে ভারতের বর্তমান সরকার বেশকিছু মহা পরিকল্পনা প্রনয়ন করার পাশাপাশি বিলিয়ন ডলার ব্যয়
করে যাচ্ছে। মুলত ২০১৮ সালের ভারতের সার্বিক সামরিক ও
প্রতিরক্ষা বাজেট ৫৪ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করা হয়। যার একটি বড় অংশ ব্যয় করা হবে বিমান বাহিনীর সর্বোচ্চ আধুনিকায়নের
জন্য। ভারতীয় বিমান বাহিনীর ফিক্সড
কমব্যাট এরিয়্যাল ক্যাপাবিলিটি বৃদ্ধি করার স্বার্থে এবং ভবিষ্যতে পর্যাপ্ত পরিমাণ
স্কোয়াডোনের ঘাটত পূরণ করার জন্য বিশ্বের প্রথম সারির জেট ফাইটার ম্যানুফ্যাকচারিং
কর্পোরেশনের সাথে যৌথভাবে মেইক ইন ইন্ডিয়ার নীতিতে নিজ দেশের মাটিতে জেট ফাইটার উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের এমারসিএ প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করে
যাচ্ছে। তার পাশাপাশি ৮.৭ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ৩৬টি এডভান্স এবং
৪++ প্রজন্মের রাফায়েল ক্রয়ের চুক্তি ইতোমধ্যেই সম্পন্ন করেছে, যা আগামী ২০১৯ সাল থেকে ভারতীয় বিমান বাহিনীতে পর্যায়ক্রমে সংযুক্ত হওয়া শুরু
হবে এবং পরবর্তীতে আরো
৩৬টি সুপার এডভান্স রাফায়েল জেট ফাইটার ক্রয়ের বিষয়টি নিয়ে ফ্রান্সের সাথে যোগাযোগ
অব্যাহত রাখা হয়েছে।
ভারতীয় বিমান বাহিনীতে এ মুহুর্তে মোট ২১০০টি বা এর কাছাকাছি জেট ফাইটার, বোম্বার, সামরিক পরিবহণ বিমান ও হেলিকপ্টার সক্রিয়
রয়েছে। যার মধ্যে আনুমানিক ৭০০ টির মতো
ফাইটার/ইন্টারসেপ্টর ও ৮০০ অধিক গ্রাউন্ড এট্যাক বা বোম্বারসহ বিশ্ব মানের আরো ২৫০টি সামরিক পরিবহন বিমান সক্রিয় রয়েছে এবং পাশাপাশি ৬৪৬টি সামরিক
পরিবহণ হেলিকপ্টার এবং ৩৮টি কমব্যাট হেলিকপ্টার ভারতের আকাশ সুরক্ষায় নিরলসভাবে
কাজ করে যাচ্ছে। কার্যত ভারত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী নীতি এবং গোপন পরমাণু
সাবমেরিনের অভিযানের পেক্ষাপটে ভারত সরকার খুবই চিন্তিত। আর সুবিশাল ভারত মহাসাগরে চীনের আগ্রাসন
ঠেকাতে মার্কিন বোয়িং ৮টি পি-৮আই লং রেঞ্জের সাবমেরিন হান্টার ব্যবহার করছে এবং
নতুন আরো ৪টি অর্ডার দেয়া আছে। এছাড়া ভবিষ্যতে ২০৩০ সালের মধ্যে এরুপ ২৪টি পি-৮আই সাবমেরিন এন্ড নেভাল শীপ
হান্টার সংযুক্ত করতে পারে। আবার আকাশ পথে এরিয়্যাল রিফুয়েলিং এর জন্য ৬টি ইলুসিন ইএল-৮৭ হেভী ট্যাংকার
সার্বক্ষণিক মোতায়েন থাকে এবং ৫টি উন্নত প্রযুক্তির এডাব্লিউএসিএস এবং ৪টি
ইলেক্ট্রনিক্স ওয়ারফার এরিয়াল সিস্টেম অপারেট করে।
বর্তমানে ভারত একাই
সর্বোচ্চ সংখ্যক রাশিয়ান চতুর্থ প্রজন্মের এডভান্স এন্ড মাল্টিরোল ক্যাপাবল ২৩৫টি
এসিইউ-৩০ এমকেআই ব্যবহার করে এবং আরো সম্পূর্ণ নতুন করে ৪০টি এসিইউ-৩০ এমকেআই বিমান বাহিনীর হাতে তুলে
দিতে এস্যেম্বলী লাইন চালু করতে যাচ্ছে হিন্দুস্থান এ্যারোনেটিকস লিমিটেড (হাল)। এছাড়া
আগামী ২০২০ সালের মধ্যে সার্ভিসে থাকা সকল
এসইউ-৩০ এমকেআই ফ্লীটকে আপগ্রেড
করার প্রক্রিয়া শুরু করতে বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিয়েছে ভারত সরকার। এর পাশাপাশি ৬৬টি
মিগ-২৯,
৫৯টি মিগ-২৭, ৪৪টি মিরেজ-২০০০, ২৩৪টি মিগ-২১, ১৪৫টির মতো জাগুয়ার ফাস্ট এটাক জেট
ফাইটার সার্ভিসে রয়েছে এবং আগামী এক বছরে ফ্রান্স থেকে নতুন করে আপগ্রেডেড অবস্থায়
৩২টি পুরনো জাগুয়ার হাতে পাবে ভারতীয় বিমান বাহিনী। তবে প্রকাশ থাকে যে, আগামী ২০২০-২০২২ সালের মধ্যে
ভারতীয় বিমান বাহিনীর বহরে থাকা মিগ সিরিজের সকল বিমান,
মিরেজ-২০০০ সহ দুই বা তিন দশকের অতি পুরনো বিমানগুলোকে বাধ্যতামুলকভাবেই অবসরে পাঠাতে
হবে। সেক্ষেত্রে নতুন বিমান ধারাবাহিকভাবে এবং পরিকল্পনা মাফিক অন্তভুক্ত করা সম্ভব
না হলে ভবিষ্যতে ভারতীয় বিমান বাহিনীর কম্ব্যাট ফিক্সড ইউংস এরিয়্যাল ক্যাপাবিলিটি
৪০% হ্রাস পেতে পারে এবং এয়ার স্কোয়াডন অর্ধেকে নেমে আসার সমুহ সম্ভবনা থেকেই যাচ্ছে।
ভারতের মোদি সরকার অতি সম্প্রতি ফ্রান্স ৩৬টি ৪++ জেনারেশনের
ডেসাল্ট রাফায়েল জেট ফাইটার ক্রয়ের বিষয়টি
চুড়ান্ত করেছে, যা আগামী ২০১৯ সাল থেকে
পর্যায়ক্রমে ভারতে আসতে শুরু করবে।
পাশাপাশি নিজস্ব প্রযুক্তিতে তেজাস এলসিএ এর প্রডাকশন ব্যাপক ভাবে শুরু করা হয়েছে। এ মুহুর্তে বিমান বহরে ৯টি হাল তেজাস এক্টিভ
থাকলেও এবং আগামী ২০২২ সালের
মধ্যে কমপক্ষে অর্ধ শতাধিক তেজাস মার্ক-১এ বিমান বহরে
সংযুক্ত হবে এবং পরবর্তীতে ২০২৫ সালের দিকে তেজাস মার্ক-২ এর ম্যাসিভ প্রডাকশন
লাইন চালু করা সম্ভব হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে ভারত তার দুইটি অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমানবাহী ক্যারিয়ারে
রাশিয়ার ৪৩টি মিগ-২৯কে এবং ১৪টি ক্যামভ কে-৩১ হেলিকপ্টার অপারেট করে যাচ্ছে এবং তাদের পুরোনো সী হ্যারিয়ারকে সম্পূর্ণভাবে অবসরে পাঠানো হয়েছে। ভবিষ্যতে নেভাল এন্ড ক্যারিয়ার বেসড ফিক্সড ইউংন্স জেট ফাইটারের ঘাটতি পূরণে
৫৭টি ক্যারিয়ার নির্ভর জেট ফাইটার সরাসরি ক্রয় বা প্রযুক্তি হস্তান্তর নীতিতে নিজ
দেশের মাটিতে যৌথ উৎপাদনের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আর এ টেন্ডার পেতে মরিয়া হয়ে কাজ করছে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১৮/এ সুপার হর্নেটের নির্মাতা বোয়িং কর্পোরেশন, ফ্রান্সের রাফায়েল-এম এবং রাশিয়ার মিকোয়ান মিগ কর্পোরেশন
তাদের মিগ-২৯কে এবং সুইডেনের সাব গ্রীপেন নেভাল ভার্সন। তবে এক্ষেত্রে ভবিষ্যতে প্রযুক্তিসহ মার্কিন বোয়িং এফ-১৮/এ সুপার
হর্নেটের আসার প্রবল সম্ভবনা রয়েছে। ভারত আবার ২২টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপার এডভান্স এএইচ-৬৪ এ্যাপাচি
এট্যাক হেলিকপ্টার ক্রয়ের চুক্তি সম্পন্ন করে। মার্কিন বোয়িং কর্পোরেশন যা আগামী ২০১৯ সাল থেকে প্রথম ব্যাচে
সরবরাহ শুরু করবে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনী ভবিষ্যতে এ রকম ৪৮টি উচ্চ
প্রযুক্তির এডভান্স এ্যাটাক হেলিকপ্টার সার্ভিসে রাখার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
এদিকে ভারত
রাশিয়ার সাথে যৌথভাবে এফজিএফএ প্রজেক্টের আওতায় স্টিলথ
টেকনোলজির পঞ্চম প্রজন্মের এসইউ-৫৭ নিয়ে বিগত এক
দশক থেকে কাজ করলেও, বর্তমানে তা এক রকম
চুড়ান্তভাবেই বাতিল হবার পথে। ভারত ইতোমধ্যেই ৫৩০ মিলিয়ন ডলার বা তার কাছাকাছি বিনিয়োগ করলেও, রাশিয়ার এসিউ-৫৭ এর প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, প্রডাকশন লাইন চালু হওয়া নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা এবং মূল্য নির্ধারণ
সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় ভারত এ প্রজেক্ট থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে
বলে অনুমান করা হয়। তবে ভারত তার নিজস্ব ভবিষ্যত প্রঞ্চম
প্রজন্মের (এএমসিএ) প্রজেক্ট নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ শুরু করলেও এখান থেকে সুফল পেতে
ভারতীয় বিমান বাহিনীকে আগামী ২০৩০ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ব্যতিত কোন পথ
আপাতত খোলা থাকছে বলে মনে হয় না।
এবার আমি চলে আসি চুড়ান্ত মূল্যায়ন
স্তরে। উপরের প্রদর্শিত তথ্য উপাত্ত এবং পরিসংখ্যান দেখে কারো মাত্রাতিরিক্ত
আনন্দিত বা উল্লাসিত হবার কিছু নেই। কারণ এ মুহুর্তে ভারতের আকাশ সক্ষমতা ও ফিক্সড
ইউংস এয়ার ক্যাপাবিলিটি যথেষ্ঠ বড় আকারের মনে হলেও, তিন দশকের অতি পুরনো প্রায় ছয় শতাধিক বিমান ২০২০-২০২২
এর মধ্যে অবসরে চলে গেলে বিমান বাহিনীর প্রকৃত আকার আশাঙ্খাজনক হারে কমে আসবে এবং
একটিভ স্কোয়াডন ঘাটতি চরম আকার দেখা দিতে পারে। আবার এ মুহুর্তে ভারতের আকাশ
স্ক্ষমতা রেড জায়ান্ট চীনের আকাশ সক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত
অগ্রসরতা বিবেচনায় অনেক পিছনে পরে আছে। তাছাড়া ভবিষ্যতে যে কোন যুদ্ধকালীন
পরিস্থিতিতে একই সাথে যুগতপতভাবে পাকিস্তান এবং চীনকে একাধিক রনাঙ্গনে কার্যকরভাবে
প্রতিহত বা মোকাবেলায় যথেষ্ঠ সক্ষমতা এখনো পর্যন্ত অর্জন করেছে কি না তা নিয়ে
কিন্তু সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। এখানে ভারত ও চীনের একটি মৌলিক পার্থক্য হলো চীনে
সামরিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন প্রকাশ্যে আনার পর বা সার্ভিসে আসার পর বিশ্ব তা
জানতে পারে। যেখানে ভারতের ক্ষেত্রে বিষয়টি পুরোপুরি বিপরীত। এক্ষেত্রে ভারত তার
এভিয়েশন টেকনোলজি বা এডভান্স এরিয়াল সিস্টেম সার্ভিসে আসার বা প্রডাকশন লাইন চালু
করার মতো স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটিকে চুড়ান্তভাবে নিশ্চিত না করেই বা
বিষয়টি চরম অনিশ্চয়তার মুখে থাকলেও প্রকাশ্যে আসার অনেক আগেই সংবাদ মাধ্যমে
অতিরঞ্জিত আকারে বা ব্যাপকভাবে প্রচার করতে থাকে। তাছাড়া, সমরাস্ত্র ক্রয় সংক্রান্ত
দূর্নীতি এবং অনিয়মকে সামনে এনে ভারতের সরকার এবং বিরোধী দলগুলোর একে অপরকে
অযৌক্তিকভাবে দোষারোপ করে যাচ্ছে। রাজনৈতির মারপ্যাচ এবং বিরোধের কারণে আর যাই হোক
না কেন, বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন
মারাত্বকভাবে ব্যহত হচ্ছে যা বলার অপেক্ষা রাখে না। যেখানে ক্লোন কপিবাজ মাস্টার
মাইন্ড চীন দূর্নীতি বা অন্যান্য গুরুত্বহীন ইস্যুকে বিবেচনায় না এনে, এক রকম নিরবেই কল্পনাতীতভাবেই প্রযুক্তিগত বিপ্লব এবং এভিয়েশন
ডেভলপমেন্ট অব্যাহত রেখেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার একাধিক এবং
স্পর্শকাতর প্রযুক্তি চুরি করে বা হস্তগত করে হলেও নিত্য নতুন জেট ফাইটার, বোম্বার, স্টিলথ ফাইটার, হেলিকপ্টার, ড্রোন এরিয়াল এন্ড ডিফেন্স সিস্টেম প্রতি নিয়ত বিশ্ববাসীর সামনে
নজিরবিহীন ভাবে উপস্থাপন করে যাচ্ছে।
সিরাজুর রহমান (Sherazur
Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, ছোট চৌগ্রাম সরকারি
প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিংড়া, নাটোর,
বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com
Comments
Post a Comment