রাশিয়ার আরএস-২৮ সারমাট আইসিবিএম সিস্টেম নিয়ে একটি সমকালীন ভাবনা।


রাশিয়ার সরকার নিয়ন্ত্রিত একাধিক সংবাদ মাধ্যম স্পুটনিক ও তাসের তথ্যমতে, রাশিয়ার মেলিটারি একাডিমি থেকে সদ্য পাশকৃত সামরিক ক্যাডেটদে সমাপনী অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, রাশিয়া বর্তমানে উচ্চ প্রযুক্তির নতুন অস্ত্র উৎপাদন ও উন্নয়ন শিল্পে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর চেয়ে কয়েক দশক এগিয়ে রয়েছে এবং উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন আধুনিক অস্ত্রগুলো রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়া বক্তব্যে তিনি তার দেশের আরএস-২৮ সারমাট বা শয়তান ২ নামক অত্যন্ত ধ্বংসাত্বক আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের কথাও উল্লেখ করেন। রাশিয়ার এই ‘স্যাটান’ বা শয়তান প্রশ্চাত্যের জার্মানি বা ফ্রান্স এর মতো বড় দেশকে সম্পূর্ণ ভাবে ধ্বংস করতে সক্ষম বলে জানানো হয়।

এ মুহুর্তে রাশিয়ান আরএস-২৮ ইন্টাল কন্টিন্যান্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইলটিকে নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ক্যাপবল বিশ্বের অতি মাত্রায় ধ্বংসাত্বক এবং শক্তিশালী আইসিবিএম ক্ষেপনাস্ত্র ব্যাবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এরএস-২৮ সারমাট বা স্যাটান বা শয়তান ২ এখনো পর্যন্ত ডেভেলপমেন্ট স্টেজে থাকলেও ইতোমধ্যেই এর একাধিক সফল গবেষণামুলক পরীক্ষা ও উন্নয়ন সম্পন্ন করা হয়েছে। মুলত বর্তমানে রাশিয়ান স্ট্র্যাটিজিক মিসাইল ইউনিটে সার্ভিসে থাকা শতাধিক সভিয়েত আমলের বিশ্বের সর্বোচ্চ শক্তিশালী আরএস-৩৬ এম-২ ‘ভয়েভোডা’ (আইসিবিএম) কে নতুন প্রজন্মের এরএস-২৮ সারমাট বা স্যাটান বা শয়তান ২ দ্বারা পর্যায়ক্রমে রিপ্লেস করতে এক রকম বদ্ধপরিকর। ২০০৯ সাল থেকে স্যাটান বা শয়তান ২ এর ডেভেলপমেট শুরু হয়েছিল এবং তা ২০২২ সালের দিকে পর্যায়ক্রমে সার্ভিসে আনতে ব্যাপক ভাবে কাজ করে যাচ্ছে রাশিয়ান স্ট্র্যাটিজিক মিসাইল ট্রুপ্স এবং মেকাইভ রকেট ডিজাইন ব্যুরো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় দোসরদের ঘুম কেড়ে নিয়ে ১লা মার্চ ২০১৮ তারিখে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী একযোগে ৬টি সারমাট বা শয়তান ২ পরীক্ষার মাধম্যে সারা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।

২২০ টন ওজনের নতুন প্রজন্মের এরএস-২৮ সারমাট বা স্যাটান বা শয়তান ২ আইসিবিএম এর সর্বোচ্চ রেঞ্জ ১১০০০ কিলোমিটার এবং বিশ্বের যে কোন স্থানে এবং সুনিদিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে সংক্ষিপ্ত সময়ে উচ্চ ধ্বংসক্ষমতা সম্পন্ন থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়ারহেড আঘাত করার বিশেষ উপযোগী করে ডিজাইন করা হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ৩৬.৩ মিটার এবং ব্যাস ৩ মিটার। এই ক্ষেপনাস্ত্রটির সর্বোচ্চ গতিবেগ টার্মিনাল ফেজে হাইপারসনিক বা ম্যাক ২০.৭ বা ২৫০০০ কিলোমিটার। এটি একসাথে ১০টি বা কোন কোন সুত্রের মতে ১৬টি মাল্টিপল ইন্ডিপেন্ডটলী টার্গেটেবল রিএন্ট্রি ভিকলস (এমআইআরভি) ওয়ারহেড বহণ করতে সক্ষম। যার প্রতিটি ওয়ারহেডকে.৩৫০-৫৫০ কিলোটন থার্মোনিউক্লিয়ার ধ্বংস সক্ষমতা সম্পন্ন করে বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে। আর সারমাট মিসাইল ডেলিভারী সিস্টেম হচ্ছে ভূমি ভিত্তিক সাইলো বেসড লাউঞ্চিং প্যাড। বর্তমানে রাশিয়া তাদের সারা দেশব্যাপী গোপন ঘাটিতে সারমাট বা শয়তান ২ ইনস্টল করার জন্য অজানা সংখ্যক নতুন সাইলো বেস ডেভলপমেন্ট করে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হয়।

তবে উচ্চ মাত্রার হাইপারসনিক গতির কারণে বর্তমানে বিশ্বে প্রচলিত আধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম যেমন থাড বা কোন সিস্টেম দ্বারা সারমাট বা শয়তান ২ কে প্রতিহত করা বা উচ্চ আকাশে ধ্বংস করা এক কথায় অসম্ভব বলে প্রকাশ করা হলেও এ বিষয়টির সাথে আমি একমত হতে পারলাম না। আবার, একটি বা দুটি সারমাট বা শয়তান ২ দিয়ে জার্মান বা যুক্তরাজ্যের মতো দেশকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে ফেলা বা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়ার বিষয়টিকেও আমার কাছে অনেকটাই হাস্যকর বলে মনে হয়েছে। তাছাড়া রাশিয়া কিন্তু সর্বদা তাদের সামরিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নিয়ে প্রচার মাধম্যে অতিরঞ্জিত তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করে থাকে। যা বাস্তবের সাথে অনেকটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। আবার রাশিয়া যদি ভবিষ্যতে যে কোন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে তার এই সারমাট নিউক্লিয়ার মিসাইল সিস্টেম কোন দেশে হীট করে বসে, সেক্ষেত্রে নিশ্চয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ফ্রান্স চুপ করে বসে থাকবে না বা শুধুমাত্র মৌখিক প্রতিবাদ জানাবে এমনটা আশা করা কিন্তু রাশিয়ার জন্য মারাত্বক আত্মঘাতী হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা না হয় বাদই দিলাম। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের কমপক্ষে একটি করে নিউক্লিয়ার পাওয়ারড সাবমেরিন সার্বোক্ষণিকভাবে শতাধিক নিউক্লিয়ার ও থার্মোনিক্লিয়ার ওয়ারহেড সমৃদ্ধ দুই ডজনের অধিক ইন্টার কন্টিন্যান্ট্যাল ব্যালেস্টিক মিসাইলসহ গোপনে সমুদ্রে মোতায়েন থাকে। আর এদের মুল টার্গেট কিন্তু রাশিয়া যা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেক্ষেত্রে আঘাত বা পালটা আঘাতে ভবিষ্যত নিউক যুদ্ধের ফলাফল দেখার জন্য রাশিয়ার কেউ বেঁচে থাকবে কি না তাও কিন্তু রাশিয়াকে শতাধিকবার ভেবে দেখতে হবে।

সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), শিক্ষক ও লেখক, sherazbd@gmail.com

Comments

Popular posts from this blog

এক লিজেন্ডারী যুদ্ধবিমান এফ-১৪ টমক্যাট ফাইটার জেটঃ

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার দ্রুত বাস্তবায়ন আর কত দূরে ?

এবার আমেরিকার এফ-১৬ যুদ্ধবিমান পেতে যাচ্ছে তুরস্কঃ