কোন পথে সৌদি আরব ও আরব বিশ্ব ?

সাম্প্রতিক সময়ে সালমান শাসিত সৌদি সরকার ইতিহাসে প্রথম বারের মতো সাধারণ জনগণের বিনোদনের জন্য সারা দেশব্যাপী পাবলিক সিনেমা হল চালু করেছে এবং সৌদি আরবকে কথিত মডারেট ইসলামিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলা এবং নারীর ক্ষমতায়ন ও দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তাছাড়া, দেশের নারীদের রাস্তায় স্বাধীনভাবে গাড়ি চালনোর অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে বর্তমান সৌদি সরকার নারীদের ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান শুরু করে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছে এবং তা রীতিমতো সারা বিশ্বে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। তবে আমি মনে করি, প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান নিয়ন্ত্রিত সৌদি সরকার তাদের চরম ব্যার্থতা, অর্থনৈতিক সংকট, অস্থিতিশীল রাজনীতি এবং সর্বপরি যুদ্ধ পরিস্থিতির মতো অতি মাত্রায় স্পর্শকাতর ইস্যুগুলোকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে কৌশলে আড়াল করতে এবং পাশাপাশি সৌদি আরবের সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে দেশে সিনামা হল তৈরি বা নারীদের গাড়ি চালানোর অধিকার প্রদানের মতো বেশ কিছু নাটকের মঞ্চায়ন করে থাকতে পারে।

এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে, বর্তমানে সৌদি সরকার তাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ইয়েমেন এবং সিরিয়ায় এক ভয়ানক এবং দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে ইয়েমেনে সামরিক আগ্রাসন শুরু করার পর থেকে এ পর্যন্ত সৌদি আরবের অন্তত ২ হাজার সেনা যুদ্ধে নিহীত হয়েছে এবং আরো আনুমানিক ৫ হাজারের অধিক মারাত্বকভাবে আহত হয়েছেন। যেখানে এই তিন বছরের সৌদি জোটের আগ্রাসনে প্রায় ১৭ হাজারের অধিক ইয়েমেনী সামরিক ও বেসামরিক লোকজন মৃত্যুবরণ করে ও পাশাপাশি ৪০ হাজারের অধিক মানুষ গুরুতরভাবে আহত হয়। যার ৮০% নারী ও শিশু। আবার এ অসম আগ্রাসী যুদ্ধ পরিচালনা করতে সৌদি সরকার তাদের সামরিক বাজেট ও অস্ত্র আমদানি ব্যাপকভাবে এবং নির্বিচারে বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। বিগত তিন বছরে ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরব অতিরিক্ত ৩০ বিলিয়ন ডলার বা তার বেশি ব্যয় করেছে এবং সিরিয়ায় আসাদ সরকার উতখাতে এবং সামরিক সহায়তার অংশ হিসেবে কোন রকম জবাবদিহীতা ছাড়াই নির্বিচারে বিলিয়ন ডলার অপব্যয় করে যাচ্ছে। আবার সৌদি আরবের ভবিষ্যত ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে সৌদি রাজ পরিবারের যুবরাজদের মধ্যে চরম দ্বন্দ্ব এবং অস্থিতিশী পরিবেশ বিরাজ করছে। এমনকী ভবিষ্যত ক্ষমতায়নকে সুনিশ্চিত করতে প্রিন্স ক্রাউন মুহাম্মদ বিন সালমান অত্যন্ত গোপনে শুদ্ধি অভিযান বা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হয়। আর তাই এসব জাতীয় সমস্যা বা ঘটনাকে বিশ্ববাসী এবং এমনকী নিজ দেশের সচেতন মহলের দৃষ্টিতে আড়াল করতেই ২০১৮ সালের শুরু থেকেই সারা জাগানো একের পর এক নতুন মহা পরিকল্পনা বা নাটকের অবতারণা করা যে হচ্ছে না তা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না।

দীর্ঘ মেয়াদী ইয়েমেন ও সিরিয়ার বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কারণে এবং তুরস্ক ও ইরানের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে সৌদি আরব নির্বিচারে তাদের সামরিক বাজেট ও উচ্চ প্রযুক্তির ধ্বংসাত্বক অস্ত্র আমদানি বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। সৌদি আরব অপ্রত্যাশিতভাবে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্টের সাথে ১১০ বিলিয়ন ডলার সমপরিমান মূল্যের বিশাল আকারের প্রাণঘাতী সমরাস্ত্র ক্রয় চুক্তি সম্পন্ন করে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক অস্ত্র বাজারে সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা রপ্তানি ও সরবরাহ চুক্তি ছিল এটি এবং চুক্তি মোতাবেক সৌদি আরব বাড়তি সুবিধা হিসেবে আগামী দশ বছর পর্যন্ত ৩৫০ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের অস্ত্র ও সাজ সরঞ্জাম সংগ্রহ করার সুযোগ পাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তাছাড়া সৌদি আরবের অন্যতম ক্ষুদ্র ও মাঝারী অস্ত্রের সরবরাহকারী হিসেবে শুধুমাত্র এপ্রিল-জুন ২০১৭ এর সংক্ষিপ্ত সময়ে যুক্তরাজ্য একাই £৮৪১ মিলিয়ন ইউরো সমপরিমানের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করেছিলো এবং ২০১৫ সালে ইয়েমেন যুদ্ধ শুরু হওয়া থেকে এ পর্যন্ত আনুমানিক ৫ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও মিসাইল সরবরাহ করে দেশটি।

গত বছর কাতারের উপর অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক অবরোধ আরপের ফলে দেশটির সাথে সৌদি আরবের কয়েক দশকের চলমান গভীর সুসম্পর্কের ইতি ঘটে। সৌদি, আরব আমিরাত, মিশর এবং বাহরাইনের সম্মিলিত জোটের অবরোধের মুখে কাতার ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি ও সমস্যার সম্মুখীন হলেও সৌদি আরব কার্যত নিজেও কিন্তু ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। আসলে কয়েক দশক ব্যাপী সৌদি আরব ছিলো কাতারের পন্য ও সেবা সরবরাহের অন্যতম উৎস এবং সৌদি আরব প্রতি বছর আনুমানিক ২০ বিলিয়ন ডলার বা সমপরিমাণ মূল্যের বানিজ্য করার সুযোগ পেত এককভাবে। কিন্তু কাতারের উপর কুটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করায় কাতারের সাথে ব্যবস্যা বানিজ্য এখন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। আর এ সুযোগে তুরস্ক ও ইরানের কৃষি ভিত্তিক উৎপাদন ফার্মগুলো সরাসরি পন্য ও সেবা রপ্তানির মাধম্যে কাতারের বাজার দখলে নিয়েছে। আর এর চরম বিরুপ প্রভাব হিসেবে সৌদি আরবের জিডিপি কয়েক দশকের মধ্যে ডিসেম্বর ২০১৭ তে -১.২% নেমে এসেছে এবং এ মুহুর্তে সৌদি আরবের বেকারত্বের হার ১৮% বা তার বেশি।

আবার ইরান ও তুরস্ক কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে তার নিজস্ব প্রাভাব বৃদ্ধি করতে এবং সৌদি প্রভাব হ্রাস করার জন্য অত্যন্ত গোপনে কাজ করে যাচ্ছে। ইয়েমেন হুতী বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও ক্ষেপনাস্ত্র সরবরাহের মাধম্যে ইরান কার্যত সৌদি আরব ও ইয়েমেনের যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করতে পরিকল্পিতভাবে উস্কে দিচ্ছে। যেখানে শান্তি স্থাপন বা যুদ্ধ বন্ধে কূটনৈতিক উপায়ে যথেষ্ঠ সুযোগ থাকলেও সৌদি আরব, ইরান কিম্বা তুরস্ক অদৃশ্য কোন এক অশুভ শক্তির কারণে এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ খেলা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারছেনা। আর এই প্রাণঘাতী এবং ভয়ঙ্কর যুদ্ধে মার্কিন ও তার সম্রাজ্যবাদী অশুভ শক্তি চরমভাবে লাভবান হলেও মুসলিম উম্মাহ এবং ঐক্য ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), শিক্ষক ও লেখক। sherazbd@gmail.com

Comments

Popular posts from this blog

এক লিজেন্ডারী যুদ্ধবিমান এফ-১৪ টমক্যাট ফাইটার জেটঃ

ভারত ও চীনের সীমান্ত উত্তেজনা...

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার দ্রুত বাস্তবায়ন আর কত দূরে ?