এক দীর্ঘ মেয়াদি ও ভয়াবহ বৈদেশিক ঋণের ফাঁদে পাকিস্তানঃ






গতকাল বুধবার পাকিস্তানের স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের দেয়া তথ্যমতে, ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মুখে থাকা পাকিস্তানকে আবারও নতুন করে ২ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ অনুমোদন করেছে চীনের শি জিং পিং সরকার। মূলত ৭.১% হারে এক বছর মেয়াদি ঋণের অর্থ আসন্ন মার্চ মাসেই ছাড় করবে চীন। আসলে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং জটিল অর্থনৈতিক সংকটের মাঝেই এবার পাকিস্তানকে আপদকালীন ২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিল চীন।




পাকিস্তান সাম্প্রতিক সময়ে গত অর্থবছরে চীন, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতকে (ইউএই) কাছ থেকে প্রাপ্ত ডলার ডিপোজিটের বিপরীতে পর্যায়ক্রমে ২৬.৬ বিলিয়ন রূপি পরিশোধ করেছে। এই তিন দেশ এর আগে পাকিস্তানের ডলার সংকট মোকাবিলায় ৯ বিলিয়ন ডলার স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের জমা দিয়েছিল। দেশটি মূলত এখন এক দেশ থেকে ঋণ নিয়ে অন্য দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে আগে থেকে নেয়া ঋণের আসল ও সুদের কিস্তি পরিশোধ করছে। যা স্বল্প আয়ের একটি দেশের অর্থনীতির জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ প্রবণতা হিসেবে থেকেই যাচ্ছে।




স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের দেয়া তথ্যমতে, গত ২০২৩ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পাকিস্তানের মোট বৈদেশিক ঋণ ও দেনার স্থিতির পরিমাণ ছিল ১৩১.১৫৯ বিলিয়ন ডলার। অথচ দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে গত ২৩শে ফেব্রুয়ারির হিসেব অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ৭.৯৫ বিলিয়ন ডলার। যা দিয়ে মাত্র ১ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর কোন সুযোগ নেই। তার পাশাপাশি ২০২৪ সালের জন্য মোট বৈদেশিক ঋণের আসল ও সুদের কিস্তি বাবদ প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার পরিশোধের বিষয়টি একেবারেই অনিশ্চিত হয়ে পড়লে এখন শেষমেশ অন্য কোন দেশ থেকে চড়া সুদে নতুন করে ঋণ নিয়ে তা দিয়ে আপাতত আগের বকেয় ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধের পথে হাঁটছে দেশটি।



এখানে প্রকাশ থাকে যে, স্বল্প আয়ের একটি দেশের বৈদেশিক ঋণের বোঝা ও ঝুঁকি বাস্তবে কোন পর্যায়ে রয়েছে তা জানার ক্ষেত্রে শুধু দেশটির জিডিপি, জিডিপির হারের সাথে তুলনা করলে তা নিশ্চিতভাবেই ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যাবে। আসলে মোট বৈদেশিক ঋণের স্থিতির বিপরীতে একটির দেশের হাতে ঠিক কতটা বা কি পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে তা সবার আগে বিবেচনা করতে হবে। আর এক্ষেত্রে মোট ঋণের বিপরীতে ৪০% এর কম বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকলে তা অবশ্যই দেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে দেশটি বার্ষিক আমদানি ব্যয় মিটিয়ে বকেয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধে অক্ষম হয়ে নিজেই নিজেকে দেউলিয়া বা বেল আউট ঘোষণা করতে বাধ্য হতে পারে।






এদিকে আবার ভারতের বৈদেশিক ঋণ ও দেনার পরিমাণ গত ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস শেষে ছিল ৬৩৫.৩ বিলিয়ন ডলার। যা পাকিস্তান অপেক্ষা ৫ গুণ বেশি মনে হলেও বাস্তবে ঋণ ব্যবস্থাপনা ও নিয়মিত পরিশোধের জন্য বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে ভারতের হাতে। যা পাকিস্তানের হাতে কখনোই ছিল না। গত ২রা ফেব্রুয়ারির হিসেব অনুযায়ী ভারতের ফরেক্স রিজার্ভ ছিল ৬২২.৪৬ বিলিয়ন ডলার। যা আমদানি ও আনুষঙ্গিক বৈদেশিক ব্যয় মিটিয়ে মোট ঋণের স্থিতির আসল ও সুদের কিস্তি পরিশোধে কোন ধরনের সমস্যা হবে না।



তাছাড়া উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে সাবলীলভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে ভারত। উইকীপিডিয়ার দেয়া তথ্যমতে, ভারতের জিডিপির আকার দেখানো হয়েছে ৩.৭৩২ ট্রিলিয়ন ডলার। যা কিনা পাকিস্তান অপেক্ষা কমপক্ষে ১০ গুণ বেশি জিডিপি। তাছাড়া গত অর্থবছরে ভারতের মোট রপ্তানি আয় হয়েছিল ৪৪৭ বিলিয়ন ডলার এবং রেমিট্যান্স আয় হয় প্রায় ১২৩ বিলিয়ন ডলার। সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের বিষয়টি পুরো বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। বর্তমানে পাকিস্তানের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা একেবারে ০% বলা চলে। কেউ নতুন করে ঋণ না দিলে এখন এমনকি এক ডলার পরিশোধ করার ক্ষমতা রাখে না দেশটি।




তাছাড়া শুধু রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে এবং অন্য দেশ ও সংস্থা থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধের জন্য আবারও বৈদেশিক ঋণ নিলে তা দীর্ঘ মেয়াদে স্বল্প আয়ের দেশের জন্য চরম মাত্রায় ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। যার একটি অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে পাকিস্তান। যা কখনোই কিন্তু একটি দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কাম্য হতে পারে না। দেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য স্বল্প আয়ের দেশগুলোকে অবশ্যই বৈদেশিক ঋণ নিতে হবে। তবে তা থাকতে হবে একটি নিদিষ্ট সীমার মধ্যেই। তার পাশাপাশি কোন উৎস বা আয় থেকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা হবে তা কিন্তু সবার আগে নিশ্চিত করা দরকার।




সিরাজুর রহমান, (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ।

Comments

Popular posts from this blog

ইএল ক্যাপ্টেন' এক অবিশ্বাস্য দ্রুত গতির সুপার কম্পিউটার!

এক লিজেন্ডারী যুদ্ধবিমান এফ-১৪ টমক্যাট ফাইটার জেটঃ

Brain-Computer Interface (BCI) technology: