দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ভবিষ্যত প্রজন্ম গঠনে চাই নিরাপদ এবং শিশুবান্ধব শিক্ষার পরিবেশঃ
আমাদের দেশের উচ্চবিত্ত এবং ধনী পরিবারের অভিভাবকদের মধ্যে শিশুকে অল্প
বয়সেই উন্নত শিক্ষা লাভের আশায় দেশের সেরা অনাবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে
কিম্বা আবাসিক বা হোস্টেল ভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি এবং প্রেরণের
হার ও প্রবণতা অত্যন্ত বেশী। যা কি না শতকরার হিসেবে ৬০% পর্যন্ত হয়ে
থাকতে পারে। আমাদের দেশে সাধারনত স্বচ্ছল এবং ধনী পরিবারগুলো তাদের
সন্তাদের আধুনিক এবং মান সম্মত শিক্ষা অর্জনের স্বার্থে শিশু প্রতি মাসিক
১৫,০০০-২২,০০০ টাকা পর্যন্ত বা এমনকী তার বেশী অর্থ ব্যয় করতে এবং
পাশাপাশি শিশুর বয়স এবং সামর্থ্য বিবেচনা না করেই আবাসিক শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করতে কোনরুপ দ্বিধা বা বাছ বিচার করেন না। এক্ষেত্রে
তাদের মূল লক্ষ্য বা প্রত্যাশা হলো তাদের আদরের সন্তান ভবিষ্যতে উচ্চ
শিক্ষিত এবং সমাজে উচ্চ শ্রেণি ভিত্তিক কর্ম ও জীবিকায় নিজেকে সম্পৃক্ত
করতে পারবে। আসলে এর মাধ্যমে কিন্তু আমরা অনেকটাই অজান্তেই আমাদের লোভ বা
ভবিষ্যত চাওয়া পাওয়াকে আমাদের কোমলমতি শিশুদের উপর চাপিয়ে দিচ্চি না তো?
এখানে প্রথমত আমাদের অনুধাবণ করতে হবে যে, ৫+ থেকে ১৪+ পর্যন্ত বয়সী
শিশুকে বিশেষ করে শিশুর ব্রেন ডেভেলপমেন্ট চলাকালীন অবস্থায় এবং বয়ঃসন্ধী
কালীন সময়ে তাকে আবাসিক বা হোস্টেল ভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা
অর্জন করতে পাঠানো শিশুর মানসিক ও শারিরীক বিকাশের জন্য চরম হুমকী এবং
উচ্চ মাত্রায় বিপদজনকও বটে। দ্বিতীয়ত, আবাসিক এবং হোস্টেল নির্ভর শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে সাধারণত কোমলমতি শিশুরা অপেক্ষাকৃত সিনিয়র শিক্ষার্থী এবং
অন্যদের দ্বারা শারিরীক বা মানসিকভাবে নির্যাতিত বা লাঞ্ছিত হওয়ার সমুহ
সম্ভবনা থেকেই যায়। আবার এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা প্রদানের
পদ্ধতি ও ধরণ আধুনিক, প্রযুক্তি নির্ভর, শিশু বান্ধব এবং নিরাপদ বলে মনে
করা হলেও বাস্তবে কিছু মান সম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যাতিত বেশিরভাগ
ক্ষেত্রেই শিশুর বয়স এবং সামর্থ্য বিবেচনায় না এনেই মাত্রাতিরিক্ত বা
তুলনামুলক কঠিন শিক্ষা কারিকুলাম অনুসরণ, কড়া অনুশাসন এবং জটিল নিয়মের
মাধম্যে নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করা হয়। বিশেষ করে কথিত এই নিরাপদবোধ
পরিবেশ অল্প বয়স্ক শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
যেখানে সারা দেশব্যাপী সমান ও মান সম্মত প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষা
ব্যবস্থা নিশ্চিত করার স্বার্থে আমাদের সম্মানিত সরকার এবং সংশ্লিষ্ঠ
মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সমন্বয়ে বিভিন্ন স্তরে শিশুর বয়স ও সামর্থ্য
অনুযায়ী জাতীয় শিক্ষাক্রম ও শিক্ষা কারিকুলাম চালু করেছেন। আবার
সরকারিভাবে সারা দেশব্যাপী তা প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সব স্তরেই
অনুসরণ এবং বাস্তবায়ন আবশ্যিকভাবে বাধ্যতামুলক করা হলেও বাস্তবে অনেক
আবাসিক/ অনাবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, ক্যাডেট
মাদ্রাসা, কেজি একাডেমি কিম্বা ব্যক্তি চালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকার
প্রদত্ত এই শিক্ষা কারিকুলাম বা গাইড লাইন যথাযথভাবে মানছে না বা অনুসরণ
করছে না।
আমাদের দেশে বিশেষ করে শহর পর্যায়ের এমনকী মফস্বল এলাকার ভালো মানের
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতি নিয়ত মুখস্ত বিদ্যা নির্ভর পরীক্ষ বা
প্রশ্ন ভিত্তিক ক্লাস টেস্ট নেওয়ার ব্যাপক প্রচলন বা প্রবণতা শিশুর
সৃজনশীলকে মারাত্বকভাবে ব্যাহত করছে। এ রকম ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষা নির্ভর
পরিবেশ শিশুর মনে সার্বক্ষণিক পরীক্ষা ভীতি এবং আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এমনকী
শিশু্র ঘুমের মধ্যেও কিম্বা স্বপ্নে পরীক্ষা বা এক্সাম টেস্ট ভীতি
চরমভাবে কাজ করে। তাই এক বিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা কোন ভাবেই এই ভয়াবহ
রীতি এবং প্রচলন পরিহার করতে পারছি না। যা আমাদের জন্য খুবই হতাশাজনক।
আসলে ইউরোপের উন্নত দেশ ফিনল্যাণ্ডে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষা
ব্যবস্থা শতভাগ সরকারি এবং একমুখী। অর্থ্যাৎ ফিনল্যান্ডে সরকার নির্ধারিত
শিক্ষা কারিকুলাম ও পদ্ধতি ব্যাতিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন কিছু
শিখানোর বা ব্যবহারের আদৌ কোন সুযোগ নেই বললেই চলে। আবার যুক্তরাজ্যে
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ১১ বছরের আগে কোন আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা বা টেস্ট
নেওয়া হয় না এবং জাপানে আইন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলোতে শিশুর ১০ বছরের
আগে কোন আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা বা টেস্টে নেওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা
হয়েছে।
তাই আমাদের দেশের শিশুরা এহেন অপেক্ষাকৃত কঠিন শিক্ষা কারিকুলাম, প্রতি
নিয়ত পরীক্ষা বা টেস্টের চাপ, আবদ্ধ এবং নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে চরম
নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এসব পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুদের মধ্যে ভবিষ্যতে এক
রকম একগুয়েমী এবং জেদী আচরণ প্রবলভাবে লক্ষ্যনীয়। তাছাড়া মুখস্ত বিদ্যা
নির্ভর এহেন পরিবেশে বেড়ে ওঠা ৯০% শিশু ভবিষ্যতে সম্মানজনক এবং বেশ ভালো
মানের ফলাফল নিয়ে নিজ পরিবারে ফিরে আসলেও তাদের মধ্য কমপক্ষে ৩০% থেকে
৪০% পর্যন্ত শিশুরা দীর্ঘ কালীন সময়ে নিজেকে একাকিত্ব বোধ করে এবং
পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে কিম্বা বাস্তব সমাজের সাথে নিজেকে খুব সহজেই
মানিয়ে নিতে পারে না। আবার মাত্রাতিরিক্ত কঠিন শিক্ষা কারিকুলমান নির্ভর
এহেন কঠোর পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুর ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে ভয়াবহ মাদকাসক্ত
কিম্বা সমাজ বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ার হার ও প্রবণরা বিপদজনক
পর্যায়ে পৌছে যাচ্ছে। যা আমাদের দেশ এবং সর্বোপরি শিশুর নিজ পরিবারের
জন্য মোটেও কাম্য হতে পারে না। তবে সকল শিশুর ক্ষেত্রে অবশ্য এ সমস্যা
দেখা দিতে পারে তা কিন্তু নয়।
শুধু ভালো ফলাফলের আশায় অল্প বয়সেই শিশুকে অহেতুক আবাসিক বিদ্যালয়ে
প্রেরণ করার অর্থই হচ্ছে শিশুকে তার পিতা মাতার স্নেহ এবং মায়া-মমতা থেকে
বঞ্চিত করা ও শিশুর আনন্দঘন শৈশবকে এক কথায় হত্যা করা। আবার ছেলে কিম্বা
মেয়ে শিশু হোক উভয়ের ক্ষেত্রেই দীর্ঘ কালীন সময়ে আবাসিক শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে অবস্থানকালীন সময়ে অন্যের দ্বারা ভয়াবহ যৌন নির্যাতন এবং
হয়রানি যে হবে না তা কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যাবে বা। তাই সমাজের একজন
সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরা এই অতি মাত্রায় স্পর্শকাতর এবং জটিল ইস্যুটিকে
কোন ভাবেই এড়িয়ে যেতে পারি না। বিশেষ করে বিগত এক দশকে আমাদের দেশের
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশু নির্যাতন এবং যৌন হয়রানিমুলক অনেক
অনাকাঙ্খিত ঘটনা এবং এমনকি শিশুর অত্মহত্যার মতো মর্মান্তিক এবং ভয়াবহ
চিত্র মিডিয়ার সামনে বার বার উঠে আসলেও এ সমস্যা সমাধানে আমরা কার্যত
উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই করতে পারছি না।
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, ছোট চৌগ্রাম
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com
Comments
Post a Comment