বন্ধ হোক মধ্যপ্রাচ্যের ভয়ঙ্কর মাত্রায় অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং প্রভাব বিস্তার!
২০১০ সাল থেকে শুরু হওয়া আরব
বসন্তের ভয়াবহ প্রভাব এবং পাশাপাশি সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া এবং ইয়েমেনে চলমান দীর্ঘ
মেয়দী অস্থিতিশীল যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে মধ্যপ্রাচ্যের বাদশা এবং আমির শাসিত দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সর্ম্পকে চরম সন্দেহ ও অবিশ্বাস বিরাজ করছে। তাছাড়া বৈশ্বিক সুপার পাওয়ার মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার পাশাপাশি আঞ্চলিক শক্তিধর দেশ সৌদি আরব, তুরস্ক এবং ইরানের
চরম মাত্রায় প্রভাব বিস্তার ও প্রতিযোগিতার ফলে উপসাগরীয় দেশগুলোর মাঝে বাড়ছে ভয়াবহ অস্ত্র প্রতিযোগিতা। আর এই সুযোগেই সারা বিশ্বব্যাপী অস্ত্র উৎপাদনকারী দেশ এবং অস্ত্র ব্যবসায়ীরা এ অঞ্চলে প্রাণঘাতী
মাল্টি বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ব্যবসার ফাঁদ খুলে বসেছে। মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ আরব দেশেই অভিজ্ঞ পাইলট না থাকলেও, তবু দুই তিনগুণ
বেশী দামে নির্বিচারে কেনা হচ্ছে যুদ্ধবিমান এবং সামরিক সাজ সরঞ্জাম।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ধনী রাষ্ট্র কাতারের সামরিক সক্ষমতার জন্য পরিচিতি কখনোই ছিল না। অথচ আমির শাসিত কাতারের সামরিক বাহিনী অতি ক্ষুদ্র আকারের
হওয়া স্বত্তেও সৌদি আরবের বৈরীতা এবং হুমকীর মুখে তার প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধি
করার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের সাথে বিগত
এক বছরের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অধিক যুদ্ধবিমান, ট্যাংক এবং সামরিক সাজ
সরঞ্জাম আমদানি বা ক্রয়ের জন্য চুক্তি সম্পন্ন করেছে। কারতের আল থানী সরকার
ইতোমধ্যেই তাদের বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ৯৬টি নতুন প্রজন্মের
যুদ্ধবিমান এবং পরিবহণ বিমান কিনতে আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সাথে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। নতুন জেটগুলোর মধ্যে রয়েছে আমেরিকার ৩৬টি এফ-১৫, ২৪টি ব্রিটেনের ইউরো ফাইটার টাইফুন এবং ২৪টি ফ্রান্সের রাফায়েল। অথচ কাতারের সামরিক বাহিনীতে সেনাসদস্য (ভাড়াটে সৈন্যসহ) মাত্র ৩০,০০০ এবং
বিমান বাহিনীতে তা আরো নিচে মাত্র ৩০০০ এর কাছাকাছি।
বিগত এক বছর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের
দেশ বাহরাইন, মিসর,
সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ উপসাগরীয় দেশগুলো কাতারের
বিরুদ্ধে এক তরফা অবরোধ আরোপ করে রেখেছে এবং তাদের অভিযোগ কাতার যেন সন্ত্রাসীদের সমর্থন দেয়া বন্ধ
করে। তবে কাতার অত্যন্ত জোরালোভাবে সৌদি জোটের এহেন মিথ্যা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছে। অবশ্য সৌদি জোটের এই অহেতুক অবরোধের পর কাতারীদের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ প্রবল আকারে বৃদ্ধি পায় এবং
সাম্প্রতিক সময়ে তাদের সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যপক
প্রচেষ্টা তার অনন্য দৃষ্টান্ত। কাতারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খালিদ
আল-আত্তিয়া জানিয়েছেন, ‘আমাদের প্রয়োজন
সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিও মোকাবেলার জন্য পরিকল্পনা করা। আমি এখন ২৫ বিলিয়ন ডলার
যথেষ্ট মনে করছি না।’
কাতারের বিমান বাহিনীতে নতুন করে ৯৬টি অত্যধুনিক যুদ্ধবিমান অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে যদিও পশ্চিমা বিশ্বের সামরিক
কর্মকর্তা এবং বিশেষজ্ঞরা খুবই আশ্চর্য
হয়েছেন। তবে যাই হোক না কেন, এতে করে
কিন্তু চুড়ান্তভাবে লাভবান হচ্ছে মার্কিন এবং ইউরোপের ডিফেন্স ম্যানুফ্যাকচারিং
হাব এবং জায়ান্ট কর্পোরেশনগুলো। অন্যদিকে ২০১৭ সালের মে মাসে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের
সফরের প্রক্কালে বিশাল আকারের ১১০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি সম্পন্ন করে সৌদি আরব। তাছাড়া আগামী ১০ বছরে আরো ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের
অস্ত্র ও সামরিক সাজ সরঞ্জামাদি সংগ্রহের বিশেষ সুযোগ পাবে
প্রিন্স ক্রাউন মোহাম্মদ বিন সালমান শাসিত সৌদি সরকার। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত পর্যন্ত তাদের সামরিক অস্ত্র
উৎপাদনের মোট প্রায় ১৮% অত্যন্ত চড়া মূল্যে রপ্তানি বা
সরবরাহ করেছে সৌদি আরবের কাছে। যার আনুমানিক মূল্য হতে পারে ২৩০ বিলিয়ন ডলারের
অধিক। তাছাড়া সৌদি আরব সরকার রাশিয়ার কাছ থেকে
অত্যাধুনিক এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম সংগ্রহের জন্য ইতোমধ্যেই পুতিন সরকারের সাথে
একটি সমঝোতা চুক্তিতে উপনীত হয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের অস্ত্র ব্যবসার অন্যতম
বড় বাজার কিন্তু সৌদি আরব। যুক্তরাজ্য
একাই ২০১৪ সাল থেকে ইয়েমেন যুদ্ধ শুরু হওয়া থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬ বিলিয়ন পাউন্ড
মূল্যের ক্ষুদ্র এবং মাঝারী অস্ত্র বিক্রি করেছে সৌদি আরবের কাছে। তাছাড়া সৌদি আরবের কাছে যেসব দেশ অস্ত্র রফতানি করে ফ্রান্স তাদের
মধ্যে অন্যতম। ফ্রান্সও কিন্তু বিগত ৫ বছরের
প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র সৌদি আরবে চালান করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক
তার জাতীয় আকাশ সীমার সুরক্ষা নিশ্চিত করার স্বার্থে
রাশিয়া থেকে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০, এট্যাক হেলিকপ্টার এবং বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ক্রয়ের পরিকল্পনা করছে। তবে আঞ্চলিক পর্যায়ের সৌদি আরব ও তার
জোটসহ বেশ কিছু দেশ চায় না যে, ইরাক সামরিক দিক দিয়ে আবারো শক্তিশালী হোক। ইরান ও তুরস্ক ব্যাতিত পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের অধিকাংশ দেশগুলো চায় ইরাক মার্কিন নিয়ন্ত্রণাধীন থাকুক। আর যুক্তরাষ্ট্র
চায় না ইরাক রাশিয়া থেকে এস-৪০০ বা অন্যান্য
সামরিক সরঞ্জাম কিনুক। বরং ইরাক সম্পর্কিত মার্কিন ট্রাম্প
প্রশাসনের অন্যতম নীতি হচ্ছে বাগদাদ ও ওয়াশিংটনের
মধ্যে বর্তমান চুক্তি ও সমাঝোতার আওতায় ইরাককে সমরাস্ত্র ক্রয় এবং
সংগ্রহ করতে হবে।
এদিকে ইসরাইলের কাছ থেকে ব্যাপক আকারের
সামরিক সাজ সরঞ্জাম, অস্ত্র এবং ড্রোন কিনতে যাচ্ছে
সংযুক্ত আরব আমিরাত। যার মূল্য প্রায় ১০ বিলিয়ন
ডলারের কাছাকাছি হতে পারে। ফ্রান্সের
ইনটেলিজেন্স অনলাইন ম্যাগাজিনে বলা হয়েছে, ইসরাইলের
দুই অস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যারোনাটিক্স ও আলবেইট সংযুক্ত আরব আমিরাতকে
অস্ত্র জোগান দিচ্ছে। তাছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিমানবাহিনী আমেরিকার সাথে ১.৬ বিলিয়ন
ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর সম্পন্ন করেছে। আবার বাহরাইন
তাদের বিমান বহরে থাকা এফ-১৬ বিমান এর সংখ্যা দ্বিগুন করার জন্য ইতোমধ্যেই
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ৪ বিলিয়ব ডলারের চুক্তি সম্পন্ন করেছে।
পরিশেষে বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের
দেশগুলোর সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার দীর্ঘ
মেয়াদী সামরিক ঘাঁটি তৈরির ফলে ইতোমধ্যে উপসাগরীয়
দেশগুলোর মধ্যে চরম বিরোধ ও উত্তেজনা ভয়াবহ আকারে
ছড়িয়ে পড়েছে। দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে আসলে আদৌ কোন আস্থা এবং বিশ্বাসের সম্পর্ক
বিদ্যামান আছে বলে মনে হয় না। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের গণতন্ত্রের
ফেরিওয়ালা, কথিত মানবতাবাদী ও সুযোগ সন্ধানী পরাশক্তিধর দেশগুলো যে যার মতো করে
মধ্যপ্রাচ্যে শত বিলিয়ন ডলারের অতি লাভবান অস্ত্র ব্যবসা ও বানিজ্য চালিয়ে যেতে এক
রকম বদ্ধপরিকর। এহেন যুদ্ধে জনপদ ধ্বংস কিম্বা হাজারো নিরীহ মানুষের প্রাণ চলে
গেলেও তারা অস্ত্র বানিজ্য এবং প্রভাব বিস্তারে কোন রকম ছাড় দিবে বলে মনে হয় না।
(Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, ৮২নং ছোট চৌগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com
Comments
Post a Comment