দক্ষিণ এশিয়ায় ভয়ঙ্কর অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং আমাদের ভবিষ্যত।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দুই চীরবৈরি প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান জঙ্গী অনুপ্রবেশ ও একাধিক স্পর্শকাতর ইস্যুতে চরম বাদানুবাদের পাশাপাশি দীর্ঘ সময়ে নিজেদের মঘ্যে ভয়াবহ এবং প্রাণঘাতী সীমান্ত সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে। বিশেষ করে ২০১৬ সালে মাঝামাঝি কাশ্মীরের উরীতে সেনা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী ও জঙ্গী হামলাকে কেন্দ্র করে দেশ দুটির মধ্যকার স্পর্শকাতর দূর্বল সম্পর্ক একেবারে তলানিতে  গিয়ে ঠেকেছে এবং সর্বশক্তি দিয়ে সীমান্ত বরাবর একে অপরকে ভয়ঙ্করভাবে প্রতিহত করে যাচ্ছে। তাছাড়া দেশ দুটির সামরিক বাহিনীর একটি বিরাট অংশ সার্বক্ষণিকভাবেই সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় মোতায়েন করার পাশাপাশি এক রকম নিরবেই পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ প্রস্তুতি চলছে বলে আশাঙ্খা প্রকাশ করছেন আন্তজার্তিক সমর বিশেষজ্ঞরা।


এখানে প্রকাশ থাকে যে, ভারত প্রায় চার দশক আগেই ১৯৭৪ সালে পারমানবিক পরীক্ষার মাধম্যে তাদের নিউক্লিয়ার ওয়ার সক্ষমতার বিষয়টি বিশ্বের সামনে তুলে ধরে। তাছাড়া, প্রায় দুই দশক আগে ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্থান পাল্টাপাল্টি নিউক্লিয়ার ফিউসন পরীক্ষা ও  প্রযুক্তি অর্জনের মাধ্যমে এক ভয়ানক নিউক্লিয়ার ও থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। এদিকে এ দুটি দেশ পারমানবিক অস্ত্র সম্প্রসারণ এবং কৌশলগত দীর্ঘ ও মধ্যম পাল্লার ব্যালেস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপনাস্ত্র উন্নয়ন ও গবেষণায় ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যা নিশ্চিতভাবেই অদূর ভবিষ্যতে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশকে ভয়াবহ রকমের নিউক্লিয়ার ও থার্মো নিউক্লিয়ার যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করা হয়। 

স্টকহোম ভিত্তিক ইন্টারন্যশনাল পীস রিসার্চ ইনিস্টিটিউটসহ আন্তিজার্তিক পর্যায়ের একাধিক সামরিক গবেষণা সংস্থা ও থিংক ট্রাংকের বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদনের তথ্যমতে, এ মুহুর্তে পাকিস্তানের অস্ত্র ভান্ডারে ১২০-১৪০টি এবং ভারতের কাছে আনুমানিক ১০০-১২০টি নিউক্লিয়ার ও থার্মো নিউক্লিয়ারর ডিভাইস এন্ড ওয়ারহেড মজুত থাকতে পারে। যদিও এ পরিসংখ্যানটি নিরপেক্ষ কোন মাধ্যমে প্রমান করার কোন সুযোগ নেই। তবে বাস্তবে এ দুটি দেশের কাছে আরো বেশি সংখ্যক বিশেষ করে ভারতের স্ট্যাটিজিক সামরিক বাহিনীর হাতে কমপক্ষে তিন থেকে চার গুন বেশি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ও ডিভাইস থাকার সমুহ সম্ভবনা থেকে যাচ্ছে। আবার এদিকে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সামরিক পরাশক্তি চীন নিশ্চিত ভাবেই অত্যন্ত গোপনেই নিউক্লিয়ার ও থার্মো নিউক্লিয়ার অস্ত্রের বিশাল মজুত গড়ে তুলছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী চীনের অস্ত্র ভান্ডারে ২৫০ এর কাছাকাছি পারমানবিক অস্ত্র থাকার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। কিন্তু ২০১৪ সালের দিকে তাওয়াইওয়ান ভিত্তিক গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বাস্তবে চীনে ভুগর্ভে একাধিক গোপন ঘাঁটি ও গবেষণাগারে নতুন প্রজন্মের ব্যালেস্টিক মিসাইল বেসড হাজারের অধিক নিউক্লিয়ার ও থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়ারহেড উন্নয়নে এবং সর্বপরি দীর্ঘ ও মধ্যম পাল্লার স্ট্র্যাটিজিক্যাল ক্ষেপনাস্ত্রের বিশাল মজুত গড়ে তুলতে বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যাচ্ছে। আরেক হিসেব মতে চীনের স্ট্যাটিজিক মিসাইল ফোর্সের নিয়ন্ত্রণে এ মুহুর্তে আনুমানিক ৬৮০টি বিভিন্ন পাল্লার কৌশলগত ক্ষেপনাস্ত্র মজুত রয়েছে। যেখানে খুব সম্ভবত ভারতের কাছে আনুমানিক ২১০টি এবং পাকিস্তানের কাছে ১৫৮টি বিভিন্ন পাল্লার স্ট্যাটিজিক্যাল ও ট্রাকটিক্যল মিসাইল সার্বক্ষণিক একে অপরের বিরুদ্ধে মোতায়েন করে রেখেছে।

পাকিস্তানের পারমানবিক ওয়ারহেড সমৃদ্ধ একাধিক ক্ষেপনাস্ত্রের মধ্যে রয়েছে মধ্যম পাল্লার শাহীন-৩, শাহীন-২ ও স্বল্পপাল্লার শাহীন-১ ক্ষেপনাস্ত্র। ভারত বা চীনের মতো ৫০০০-৮০০০ কিলোমিটারের দীর্ঘ পাল্লার কৌশলগত ব্যালিস্টিক মিসাইল না থাকলেও পাকিস্তান অবশ্য ইতোমধ্যেই তাদের মোবাইল লাউঞ্চ বেসড মাঝারি পাল্লার ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপ যোগ্য শাহিন-৩ ক্ষেপণাস্ত্রের একাধিক সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করে এবং পাকিস্তানের তৈরি শাহিন-৩ ক্ষেপনাস্ত্রের সর্বোচ্চ ২,৭৫০ কিলোমিটার দূরুত্বের যে কোন লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁত ভাবে পারমাণবিক ও প্রচলিত ওভারহেড আঘাত হানতে সক্ষম। যদিও শাহিন-৩  ক্ষেপনাস্ত্র সর্বোচ্চ ৪৮ কিলোটন ক্ষমতা সম্পন্ন পারমাণবিক ওয়ারহেড বহন করতে পারে এবং এই ক্ষেপণাস্ত্রটি টার্গেটের ৩৫০ মিটারের মধ্যে আঘাত করতে সক্ষম। এছাড়া ১৫০০ কিলোমিটার পাল্লার শাহীন-২ এবং ৯০০ কিলোমিটার পাল্লার শাহীন-১ ক্ষেপনাস্ত্র মজুত আছে। আবার পাকিস্তানের ভারত সীমান্ত বরাবর আজানা সংখ্যক ৬০ কিলোমিটার পাল্লার ট্যাকটিক্যাল সর্ট রেঞ্জ নসর ক্ষেপনাস্ত্র মোতায়েন করেছে, যা পাকিস্তানের দৃষ্টিতে এটি একটি গেম চেঞ্জার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করছে। তাছাড়া পাকিস্তানের সাবমেরিন ভিত্তিক বাবর-২ এবং বাবর-৩ নিউক্লিয়ার ক্যাপাবল ক্রুজ মিসাইলের সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করে এবং তাদের নৌবহরে থাকা সাবমেরিনে গোপনে ইনস্টল সম্পন্ন করে বলে মনে করা হয়। এছাড়া সবচেয়ে নতুন খবর হলো পাকিস্তান ফেব্রুয়ারী ২০১৮ এর শুরুতে আরব সাগরে তাদের স্ট্যাটিজিক মিসাইল শাহিন-৩ এর আপগ্রেড ভার্সন শাহিন-৪ এর মিসাইল ফায়ারিং টেস্ট শুরু করতে যাচ্ছে। খুব সম্ভবত শাহিন-৪ এর পাল্লা হতে পারে ৩৫০০-৩৮০০ কিলোমিটার বা তার কাছাকাছি। যদিও বিষয়টি এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।

এদিকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ভারতের নিজস্ব কৌশলগত পারমাণবিক ওয়ারহেড সমৃদ্ধ ৩৫০০ কিলোমিটার পাল্লার অগ্নি-৪ অনেক আগে থেকেই মজুত আছে। আবার সাম্প্রতিক সময়ে ভারত তার কৌশলগত উচ্চ প্রযুক্তি সম্পন্ন নতুন প্রজন্মের ৫৫০০-৮০০০ কিলোমিটার পাল্লার অগ্নি-৫ ব্যালেস্টিক ক্ষেপনাস্ত্রের সফল উৎক্ষেপন পরীক্ষা সম্পন্ন শেষে ২০১৭ সালেই সামরিক বাহিনীর স্ট্যাটিজিক মিসাইল ইউনিটের কাছে হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু করে। আবার ভারতের পরমানু অস্ত্রবাহী স্ট্র্যাটিজিক্যাল অগ্নি-৫ ক্ষেপণাস্ত্রে একসাথে তিনটি ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম এবং তা সর্বোচ্চ ৩৫০ কিলোটনে সক্ষমতার নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড বহন করার বিশেষ উপযোগী করে ডিজাইন করা হয়েছে। এতে করে অগ্নি-৫ এর রেঞ্জের মধ্য চলে এসেছে পাকিস্তানের সম্পূর্ণ এলাকাসহ চীনের একটি বিরাট অংশ। আবার ভারত পাকিস্তানের সীমান্ত বরাবর অজানা সংখ্যক সুপারসনিক গতির ২৯০-৪৫০ কিলোমিটার পাল্লার বারমোস শর্ট রেঞ্জ মিসাইল সিস্টেম মোতায়েন করে রেখেছে। তাছাড়া সাম্প্রতিকতম সময়ে ভারত ৮০০ কিলোমিটার পাল্লার সুপারসনিক বারমোস মিসাইলের একাধিক সফল পরীক্ষা করে। এছাড়া ভারতের ডিফেন্স রিসার্চ অর্গানাজেশন (ডিঅরডিও) নিজস্ব উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন পাল্লার আকাশ, ত্রিশুল ও সাবসনিক নির্ভয় ক্রুজ মিসাইলের একাধিক ভার্সন সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করে ম্যাসিভ প্রডাকশন শুরু করতে যাচ্ছে। এদিকে আবার ভারত অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক তাদের নিজস্ব নিউক্লিয়ার সাবমেরিন ভিত্তিক “সেকেন্ড ইন নিউক্লিয়ার এট্যাক ক্যাপাবিলিটি” ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিলিয়ন ডলার খরচ করে যাচ্ছে। ভারত ইতোমধ্যেই তাদের সাবমেরিন ভিত্তিক ৩৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাল্লার কে-৪ ব্যালেস্টিক মিসাইলের একাধিক পরীক্ষা সম্পন্ন করে সাবমেরিনে অজানা সংখ্যক কে-৪ এসএলবিএম সংযোজন শুরু করেছে। যা নিশ্চিতভাবে বিশেষ করে চীনের জন্য একচি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে থেকে যাচ্ছে। এতে করে ভবিষ্যতে পাকিস্তান ও ভারতের উভয়ের পক্ষে এমন কি সুপার পাওয়ার চীনের পক্ষেও যে কোন অবস্থায় একে অপরের বিরুদ্ধে পারমানবিক ক্ষেপনাস্ত্র হামলা নিজের জন্য একটি ভয়ঙ্কর আত্মঘাতী কাজ হবে যা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তাছাড়া, প্রচলিত যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধের সক্ষমতায় ভারত খুব দ্রুত বিশ্বের বৃহৎ সামরিক পরশক্তির সমপর্যায়ে নিয়ে যেতে বিপুল বিলিয়ন ডলার ব্যয় করার পাশাপাশি নিজস্ব প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ভারত প্রায় ১০.০০ বিলিয়ন ডলার প্রজেক্টের আওতায় নিজস্ব অ্যান্টি ব্যালেস্টিক মিসাইল সিস্টেম হিসেবে এএডি (অ্যাডভান্স এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) ও পিএডি (পৃথ্বী এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) সারা দেশব্যাপী গড়ে তুলছে ব্যাপক ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এতে করে ভারত ভবিষ্যতে পাকিস্তানের যে কোন ক্ষেপনাস্ত্র আক্রমনের ৮০% পর্যন্ত নিশ্চিত ভাবেই আকাশেই ধ্বংস করতে সক্ষম হবে বলে মনে করা হয়। এদিকে কিন্তু পাকিস্তানের নিজস্ব আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে দুই বা তিন রেজিমেন্ট চীন থেকে মিডিয়াম রেঞ্জের এইচকিউ-১৬এ বা এইচকিউ-৯ সারফেস টু এয়ার মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েন করে বলে মনে করা হয় এবং পাশাপাশি রয়েছে নিজস্ব প্রযুক্তির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।

সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, জয়কুড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com

Comments

Popular posts from this blog

এক লিজেন্ডারী যুদ্ধবিমান এফ-১৪ টমক্যাট ফাইটার জেটঃ

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার দ্রুত বাস্তবায়ন আর কত দূরে ?

এবার আমেরিকার এফ-১৬ যুদ্ধবিমান পেতে যাচ্ছে তুরস্কঃ