সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর কোরিয়ার কীম সরকার একাধিকবার দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এবং সর্বোপরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুল ভূখণ্ডে পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার হুমকি মাধ্যমে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে ভয়াবহ রকমের অস্থিতিশীল পরিবেশ এবং সামরিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে যাচ্ছে। অবশ্য আন্তর্জাতিক সামরিক ও প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক মতে, উত্তর কোরিয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের নিজস্ব সামরিক সক্ষমতা জাহির করা এবং অত্র অঞ্চলে কৌশলগত অবস্থান ও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মতো ঝুঁকিপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিবৃতি দিয়ে থাকতে পারে। আর এক্ষেত্রে সামরিক বিশেষজ্ঞরা উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র এবং পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়ন ও সক্ষমতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলেও কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওবামা প্রশাসন ও পেন্টাগন পিয়ংইয়ং এর হুমকি এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে ভবিষ্যতে যে কোন যুদ্ধ হামলা মোকাবিলায় তাদের এশিয়া প্যাসিফিক এউএস নেভাল এন্ড এয়ার ফ্লীটকে সর্বোচ্চ সর্তক অবস্থায় মোতায়েন করে রেখেছে।

মুলত আজকের প্রবন্ধে আমি উত্তর কোরিয়ার কীম সরকারের পাগলামী বা হুমকির ইস্যুতে আলোকপাত না করে বরং সার্বিকভাবে উত্তর কোরিয়ার সামরিক ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতার বিষয়টি আমার স্বল্প পরিসর জ্ঞানে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করার চেষ্টা করব মাত্র। আসলে উত্তর কোরিয়ার চলতি বছরের সামগ্রিক সামরিক ও প্রতিরক্ষা বাজেট ৬.৭০ বিলিয়ন ডলার। সেনাবাহিনীতে কর্মরত নিয়মিত সৈন্য ৯২৩০০০ জন এবং আরও রিজার্ভ সৈন্য আছে প্রায় ৪৫০০০০। এছাড়া গ্রাউন্ড ফোর্সের আওতায় ৪২০০টি ট্যাংক,  ২২৫০টি আরমোর্ড ফাইটিং ভ্যাসেলস, ৪২০০টি হেভি আর্টিলারী গান ও হিটলার এবং ৪২০০টি মাল্টিপল লাউঞ্চিং রকেট সিস্টেম। তবে প্রকাশ থাকে যে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীতে ব্যবহৃত ট্যাংকের বড় অংশই সোভিয়েত আমলের মেইন ব্যাটল ট্যাংক হিসেবে টি-৫৫, টি-৫৯, টি-৬২ এবং চীনের তৈরি কিছু সংখ্যক এমবিটি-২০০০। এছাড়া দুই হাজারের মতো নিজস্ব উৎপাদিত ট্যাংক এবং সেলফ প্রোপেলড হাউটজার আছে।

উত্তর কোরিয়ার বিমান বাহিনীতে মোট ৯৪৪টি যুদ্ধবিমান, বোম্বার এবং পরিবহণ বিমান রয়েছে। যার মধ্যে অধিকাংশই সোভিয়েত আমলের ষাট ও সত্তর দশকের তৈরি যুদ্ধবিমান। ষাটের দশকের চীনের তৈরি এফ-৫ ১০৬টি , এফ-৬ ৯৭টি, এফ-৭ ১২০টি, কিউ-৫ ৪০টি, এইচ-৫ ৮০টি। এছাড়া মিগ-২১ ২৬টি, মিগ-২৩ ৫৬টি এবং চতুর্থ প্রজন্মের মিগ-২৯ ৩৫টি, এসইউ-২৫ ৩৪টি। এছাড়া প্রশিক্ষণ বিমান রয়েছে ১৬৯টি এবং পরিবহণ বিমান ১০০টি। আবার পরিবহণ ও ইউটিলিটি হেলিকপ্টার রয়েছে ২০২টি ও এট্যাক ও কমব্যাট হেলিকপ্টার এমআই-২৮ রয়েছে ২০টি।

অবশ্য উত্তর কোরিয়ার নেভাল ফ্লীট বেশ বৈচিত্র্যময়। নৌ বাহিনীর হাতে এ পর্যন্ত এক্টিভ ফ্রীগেট আছে ৩টি, কর্ভেট ২টি , লাইট মিসাইল বোট ২৮টি, কোস্টাল ডিফেন্স জাহাজ ১৫০টি এবং মাইন ওয়ারফেয়ার ২৩টি। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার উত্তর কোরিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক ডিজেল ইলেকট্রিক চালিত রোমিও ক্লাস এবং স্যাং-ও ক্লাস সাবমেরিন ব্যবহার করে যার সংখ্যা ৭০টি এবং পরিমাণগত বিচারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই উত্তর কোরিয়ার অবস্থান।

আবার অন্য দিকে উত্তর কোরিয়া নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়া প্রতিনিয়ত স্বল্প ও মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করে থাকে। তবে আনুমানিক উত্তর কোরিয়ার হাতে প্রায় ৩০০০টি মধ্যম ও দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মজুত রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ২৫০০-২৭৫০ কিলোমিটার। এছাড়া নিজস্ব আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তেমন শক্তিশালী না হলেও নিজস্ব উৎপাদিত স্বল্প পাল্লার সারফেস টু এয়ার মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমই মূল ভরসা।

এছাড়া উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়ন ও গবেষণা নিয়ে আন্তর্জাতিক সামরিক অঙ্গনে নানান সমালোচনা ও সংশয় প্রকাশ করা হলেও সিআইএর এক গোপন রিপোর্টে উত্তর কোরিয়ার কাছে এ পর্যন্ত ৮-১২টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় এবং মাস খানেক আগে উত্তর কোরিয়া শক্তিশালী থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়েপপনস পরীক্ষার মাধ্যমে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে ভয়াবহ রকমের সামরিক উত্তেজনা ও ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে। তবে আর যাই হোক উত্তর কোরিয়া এখনো পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া প্যাসিফিক এয়ার এন্ড নেভাল ফ্লীটের মোকাবিলায় নূন্যতম সামরিক সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি এবং অত্যন্ত দূর্বল আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং অতি পুরাতন যুদ্ধবিমান বহর দিয়ে তারা কোন ভাবেই দক্ষিণ কোরিয়া এবং সর্বোপরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোকাবিলা করতে পারবে না যা এক রকম নিশ্চিত। তবে আর যাই হোক উত্তর কোরিয়ায় সামরিক জান্তা সরকার প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা ও দমনমুলক নীতি অবলম্বন করে নিজ ক্ষমতা ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর এবং খুবই আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে উত্তর কোরিয়ার সাধারণ জনগণের কাছে ইন্টারনেট ও আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করার কোন সুযোগ নেই এবং বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বসবাস করে যাচ্ছে যা খুবই হতাশাজনক। এছাড়া জাতিসংঘ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অসংখ্য নিষেধাজ্ঞার কবলে বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা এক রকম ধ্বংসপ্রাপ্ত।

সিরাজুর রহমান,
সহকারী শিক্ষক ও প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক,
সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ।
Sherazbd@gmail.com

Comments

Popular posts from this blog

এক লিজেন্ডারী যুদ্ধবিমান এফ-১৪ টমক্যাট ফাইটার জেটঃ

ভারত ও চীনের সীমান্ত উত্তেজনা...

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার দ্রুত বাস্তবায়ন আর কত দূরে ?