কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-কেন্দ্রিক শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে আমাদের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা!



একবিংশ শতাব্দীর ২০২৫ সালে এসে আমরা প্রযুক্তির জগতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এক বাস্তব, সমৃদ্ধ ও অত্যন্ত কার্যকর রূপ প্রত্যক্ষ করছি। AI এখন মানুষের জীবনযাপন, কাজের ধরণ, শিল্প উৎপাদন, গবেষণা এবং সর্বপরি শিক্ষাকে অভূতপূর্ব গতিতে প্রভাবিত করছে। তবে এই অভাবনীয় প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কিছু বাস্তব চ্যালেঞ্জও, যা মোকাবিলায় আমাদের আরও সচেতন হতে হবে।




আজ AI কেবল সেকেন্ড নয়, বরং ন্যানোসেকেন্ডের গতিতে ডেটা বিশ্লেষণ ও জটিল সমস্যা সমাধান করছে। কিন্তু অনেকেই ভাবেন, এআই মানেই কেবল ছবি, ভিডিও তৈরি করা বা পড়াশোনা না করেই লেখা বানিয়ে নেওয়া। অথচ উন্নত বিশ্ব প্রায় এক দশক আগে থেকে শিল্প উৎপাদন, মহাকাশ গবেষণা, আবহাওয়া বিশ্লেষণ, কৃষি প্রযুক্তি, ডিফেন্স সিস্টেম, চিকিৎসা, এভিয়েশন, অটোমোবাইলস, রোবটিক্স এবং ভবিষ্যতের উচ্চ প্রযুক্তি উন্নয়নে AI-কে মূল চালিকা শক্তি হিসেবে ব্যবহার করছে।



এই অভাবনীয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা, উন্নয়ন ও বাস্তব ব্যবহারে এখন চীন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ইসরাইল, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভারতের মতো দেশগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। অথচ এদিকে আমরা এখনো AI প্রযুক্তির শুধু সীমিত ব্যবহারকারী হিসেবে রয়ে গেছি। আর এক্ষেত্রে গবেষণা, উদ্ভাবক বা নির্মাতা হিসাবে আমাদের অবস্থান অনেকটাই দূর্বল।



অথচ এই অভাবনীয় AI-কেন্দ্রিক প্রযুক্তি উন্নয়নের পেছনে লুকিয়ে রয়েছে কোডিং, ডেটা, সুপারকম্পিউটিং, উন্নত অ্যালগরিদম এবং হাজারো গবেষক-প্রযুক্তিবিদের কঠোর পরিশ্রম ও সর্বপরি উন্নত দেশগুলোর বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ।



বৈশ্বিক পর্যায়ে AI হাব হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চীন ইতোমধ্যেই “New Generation AI Development Plan”–এর আওতায় জাতীয় পর্যায়ে AI-কে কৌশলগত অগ্রাধিকার দিয়েছে। চীনে বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও সীমিত পরিসরে AI literacy, কোডিং এবং রোবটিক্স শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা শুরু হয়েছে।



অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রেও শিক্ষার্থীদের জন্য STEM ও AI-কেন্দ্রিক শিক্ষা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যার আলোকে K–12 স্তরের পাঠ্যক্রম আধুনিকায়নের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান, গবেষণা এবং প্রযুক্তি-কেন্দ্রিক অর্থনীতির জন্য নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করতে চায় আমেরিকার সরকার। তবে এটি এখনো পূর্ণমাত্রায় বাধ্যতামূলক করা হয়নি, বরং এই মহা পরিকল্পনা পর্যায়ক্রমে ও দ্রুত বাস্তবায়ন করতে চায় দেশটি।



বর্তমানে বৈশ্বিক পর্যায়ে AI-কেন্দ্রিক প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে বড় দুই শক্তি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। একাধিক থিংক ট্যাংকের গবেষণা অনুযায়ী, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের Google, Meta, Amazon, Microsoft, Nvidia ও OpenAI মিলে প্রতি বছর আনুমানিক ৭০-৮০ বিলিয়ন ডলার AI গবেষণা, ডেটা সেন্টার, সাইবার নিরাপত্তা, মহাকাশ গবেষণা, ডিফেন্স সিস্টেম এবং উন্নত AI মডেল তৈরিতে বিনিয়োগ করছে বলে ধারণা করা হয়।



অন্যদিকে চীন “Made in China 2025” এবং AI কেন্দ্রিক জাতীয় নীতিমালার আলোকে সুপারকম্পিউটিং, চিপ উন্নয়ন, 5G–6G নেটওয়ার্ক, স্মার্ট সিটি ও AI নির্ভর ডিফেন্স সিস্টেম অ্যান্ড স্পেস সাইন্স গবেষণায় প্রতি বছর আনুমানিক ৫-৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। যদিও বাস্তবে এই তথ্য উপাত্ত কিছুটা কম বা বেশি হতে পারে।



তাছাড়া আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত গত কয়েক বছরে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে AI-কেন্দ্রিক সেক্টরে দ্রুত আগ্রগতি অর্জন করেছে। বিশেষ করে “IndiaAI Mission”, “Digital India” এবং “Make in India” উদ্যোগের অংশ হিসেবে দেশটি AI গবেষণা, চিপ–উৎপাদন, ডেটা সেন্টার ও স্টার্টআপে বছরে আনুমানিক ৮-১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে।



এদিকে ইউরোপে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স এবং বিশেষ করে নেদারল্যান্ডস AI নির্ভর গবেষণা, রোবটিক্স এবং সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। বিশেষ করে নেদারল্যান্ডসের ASML পৃথিবীর একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যা চিপ ম্যানুফ্যাকচারিং এর মূল প্রযুক্তি হিসেবে EUV lithography machine তৈরি করে, যা উচ্চ প্রযুক্তির সেমিকন্ডাক্টর বা চিপ তৈরির জন্য অপরিহার্য।



এখানে প্রকাশ থাকে যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) আজ ভবিষ্যতের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং বিশেষ করে বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। তাই আমাদের মতো উন্নয়নশীল ও স্বল্প আয়ের দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর থেকেই উন্নত বিশ্বের পর্যায়ের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও অভাবনীয় AI-কেন্দ্রিক জ্ঞানচর্চা সীমিত পরিসরে হলেও বাস্তবায়ন করা উচিত।



তার পাশাপাশি একইসঙ্গে পরিকল্পিতভাবে দেশের সকল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়ে উন্নত গবেষণা, AI ল্যাব, রোবটিক্স ল্যাব এবং বিশেষ করে উৎপাদনমুখী শিল্পখাতের সঙ্গে যৌথ সহযোগিতা বা সেতুবন্ধন স্থাপন করা এখন সময়ে দাবি হয়ে দেখা দিয়েছে। এখান আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীদের কেবল ব্যবহারকারী নয়, বরং উদ্ভাবক, প্রোগ্রামার, গবেষক ও সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, গবেষণা ও সামর্থ অনুযায়ী বিনিয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।



এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে, আমাদের সীমিত পরিসরে হলেও প্রযুক্তি্গত উন্নয়নে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হবে। যদি আমরা শুধুই বিদেশি প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল থাকি, তবে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আমাদের অবস্থান সবসময়ই পিছনেই রয়র যাবে। তাই নতুন প্রজন্মের মেধা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে গবেষণা, বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নয়ন এবং সময়োপযোগী নীতি গ্রহণ করাই হবে ভবিষ্যতের সঠিক পথ।



পরিশেষে বলা যায়, আমরা এখন কেবল শুধু AI-এর সীমিত ব্যবহারকারী নয়, বরং উদ্ভাবক, নির্মাতা এবং বৈশ্বিক প্রযুক্তি বাজারের অংশীদার হিসেবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে চাই। তাই সঠিক পরিকল্পনা, আধুনিক ও প্রযুক্তি-কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা, গবেষণা এবং দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশও অদূর ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর শিল্প, অর্থনীতি ও গবেষণায় দ্রুত এগিয়ে যেতে পারবে।



(নিজস্ব বিশ্লেষণ, তথ্য ও ছবি সংগ্রহিত)



লেখক পরিচিতি:

সিরাজুর রহমান
শিক্ষক ও লেখক
সিংড়া, নাটোর,
বাংলাদেশ।

Comments

Popular posts from this blog

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ছাপানো পবিত্র কুরআন মাজীদ!

প্রাণের খোঁজে শনির চাঁদ টাইটানে নাসার এক বৈপ্লবিক “ড্রাগনফ্লাই” স্পেস মিশন!

ইএল ক্যাপ্টেন' এক অবিশ্বাস্য দ্রুত গতির সুপার কম্পিউটার!