দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সুইজারল্যাণ্ডের দ্বিমুখী নিরপেক্ষ যুদ্ধ নীতিঃ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইউরোপের একটি দেশ ভয়ঙ্কর দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করে নিরপেক্ষতার মুখোশ পড়ে থাকে। দেশটি আর কেউ নয়, সেটি হলো সুইজারল্যাণ্ড। হ্যাঁ আপনি ঠিকই শুনেছেন। সুইজারল্যান্ড কার্যত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পুরোটা সময় ধরে অক্ষশক্তি এবং মিত্র পক্ষের দেশগুলোর ধনী সামরিক এবং বেসামরিক ব্যক্তিবর্গের অর্থ ও সম্পদ জমা রাখার এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠে। জার্মানীর হিটলারের নাৎসী বাহিনীর শত শত জেনারেল এবং সামরিক কর্মকর্তা এবং সাধারণ ব্যক্তিবর্গ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অর্থ একাধিক সুইস ব্যাংকে জমা রাখতে থাকে। পাশাপাশি ফ্রান্স, ব্রিটেন, পোলিশ, অস্ট্রিয়া ছাড়াও অন্য দেশের ধনী সামরিক এবং বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ একই পথ অবলম্বন করে বিপুল পরিমাণ অর্থ সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত রাখতে শুরু করে। আর এসব অর্থের বেশিরভাগই ছিল কিন্তু অবৈধ পথে উপার্জিত অর্থ বা কালো টাকা।

তাছাড়া যুদ্ধের কারণে নিজ দেশে অর্থ রাখাটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ মনে করায় মিত্রশক্তি এবং অক্ষশক্তি জোটভুক্ত দেশের বিত্তশালী নাগরিকরা এক রকম নির্বিচারেই যুদ্ধমুক্ত সুইজারল্যাণ্ডের সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচার করাকে আর্থিকভাবে নিরাপদ মনে করে। সুইজারল্যাণ্ডে এভাবে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ সম সাময়িক কালে শত বিলিয়ন ডলারের সীমাকেও ছাড়িয়ে যায়। আর ভয়ঙ্কর যুদ্ধ কবলিত ইউরোপীয় দেশ ও তার নাগরিকদের রক্তে আর মৃত্যুর বিনিময়ে অর্জিত এসব অর্থে সুইজারল্যাণ্ড নিরপেক্ষতার মুখোশে এক বিশাল সম্পদের স্তুপ গড়ে তুলে এবং খুব অল্প সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ইউরোপের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রে পরিনত হয়। কিন্তু সুইজারল্যাণ্ডের একাধিক সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা অর্থের মূল মালিক বা দাবিদারের একটি বড় অংশই যুদ্ধে করুণ মৃত্যুবরণ করলে অধিকাংশ অর্থ সুইজারল্যাণ্ডের নিজস্ব মালিকানায় চলে যায় এবং এটিই ছিল সুইস সরকারের বিংশ শতাব্দীর একটি ভয়ঙ্করতম প্রতারণা এবং আর্থিক জালিয়াতি। আর এহেন জালিয়াতি বা প্রতারণা নিয়ে সুইস কর্তৃপক্ষ কোন কালেই কিন্তু মোটেও অনুতপ্ত ছিলা না। তবে দূঃখজনক হলেও সত্য যে, এজন্য তাকে যুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক আইনের কাঠ গোড়ায় দাড়াতে হয় নি। অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে যুক্তরাজ্য বা ব্রিটেন সরকার সুইজারল্যাণ্ডের এহেন হঠকারী প্রতারণা এবং দ্বিমুখী নীতির উপর চরম মাত্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে তার বহরে থাকা তিন শতাধিক বোমারু বিমানকে চুড়ান্তভাবে প্রস্তুত করে সুইজারল্যাণ্ড হামলা করার জন্য। অবশ্য শরিক দেশগুলো সুজারল্যাণ্ডে হামলার পরিকল্পনার চরম বিরোধীতা করে এবং যুক্তরাজ্যকে শান্ত করে শেষ পর্যন্ত এ হামলা করা থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়।

সবচেয়ে দূঃখের বিষয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নারাক্কাজনক এবং দ্বিমুখী নিরপেক্ষতার মুখোশ পড়ে সুইজারল্যাণ্ড যে মানবতা বিরোধী কাজ করেছিল তার জন্য সে কিন্তু মটেও অনুশোচনা করেনি বা এহেন অপকর্মের জন্য বিশ্বের কাছে ক্ষমা প্রাথনা করেছে তাও কিন্তু নয়। মনে করা হয় সুইজারল্যাণ্ডের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি হতে বছর খানেক বেশি সময় লাগে এবং বিশেষ করে হিটলার বাহিনীর এবং ক্ষেত্র বিশেষে মিত্র বাহিনীর যুদ্ধাস্ত্র এবং সামরিক সাজ ও সরঞ্জাম ক্রয়ে অত্যন্ত গোপনে চড়া সূদে অর্থের যোগান দিত দেশটি। তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মানবতা ও গণতন্ত্রের মুখোশ পড়ে এবং শান্তিপ্রীয় দেশের লেবাস লাগিয়ে তার কলঙ্কিত এবং প্রতারণামুলক জালিয়াতি ব্যাংকিং ব্যাবসা নিরবিচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যাচ্ছে সুইজারল্যাণ্ড। এক পরিসংখ্যানের হিসেব মতে, বর্তমানে সারা বিশ্বের দেশগুলোর এমনকী ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মতো দেশগলোর কালো ও অবৈধ টাকার শেষ গন্তব্যস্থল হচ্ছে সুইজারল্যাণ্ডের সুইস ব্যাংকগুলো। তাছাড়া সারা বিশ্বজুড়ে চলা ২০০ বিলিয়ন ডলারের অবৈধ অস্ত্র, মানব পাচার, এবং ড্রাগস বানিজ্যের ৬০% পর্যন্ত অর্থ চলে যায় সরাসরি সুইস ব্যাংকের একাউন্টগুলোতে। এ মুহুর্তে সুইস ব্যাংকে কি পরিমাণ বৈদেশিক মালিকানার কালো ও অবৈধ পথে অর্জিত অর্থ ও সম্পদ গচ্ছিত রয়েছে তা জানা সম্ভব না হলেও অনুমান করা হয় তাদের সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত মোট অর্থের পরিমাণ ১.০০ ট্রিলিয়ন ডালারের কাছাকাছি হতে পারে।

সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক এবং লেখক, ছোট চৌগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিংরা নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com


Comments

Popular posts from this blog

এক লিজেন্ডারী যুদ্ধবিমান এফ-১৪ টমক্যাট ফাইটার জেটঃ

ভারত ও চীনের সীমান্ত উত্তেজনা...

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার দ্রুত বাস্তবায়ন আর কত দূরে ?