বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিটেন্স এর অবদান।

মহান স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী ১৯৭৩ সালে মাত্র ১০.০০ মিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স দিয়ে যে নতুন অর্থনৈতিক যুগের সূচনা হয় তা আজ ৪৫০% বৃদ্ধি পেয়ে গড়ে ১৩.০০ বিলিয়ন ডলারে পৌছেছে এবং নিশ্চিতভাবেই বিগত চার দশক ধরে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বৈদেশিক কারেন্সি রিজার্ভ সমৃদ্ধকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে যাচ্ছে। মুলত ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে আনুমানিক ৯.৬০ মিলিয়ন শ্রমিক এবং পেশাজীবী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছে যার অধিকাংশই কাজ করছেন মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কাতার, ওমান, কুয়েত, আরব আমিরাতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে। বাংলাদেশ থেকে ২৮ লক্ষ শ্রমিক ও পেশাজীবী জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ডিসেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত বিদেশে পাঠানো হয়েছে এবং ঠিক একই সময়ে প্রায় ৮৭.৯৫ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ দেশে এসেছে যদিও এই সময় মালয়েশিয়ার শ্রম বাজার এক রকম বন্ধ ছিলো। তাছাড়া, সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে চরম অস্থিতিশীল রাজনৈতিক সংকট ও যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করায় বিগত চার বছর ধরে রেমিটেন্স প্রবাহে কিছুটা ভাটা দেখা দিয়েছে। আবার অন্যদিকে, ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে সর্বোচ্চ ১৫.৩১৭ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা বাবদ দেশে আসে রেমিটেন্স খাত থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রেমিটেন্স সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আমাদের সম্মানিত প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিক ও পেশাজীবীরা চলতি ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ১১৪৯.০০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠায়, বাংলাদেশী মুদ্রায় ৯৫২৭.০০ কোটি টাকা। এছাড়া, চলতি বছরের জানুয়ারী মাসে আসে ১৩৭৯.৭৯ মিলিয়ন ডলার বা ১১৪২৭.০০ কোটি টাকা এবং ডিসেম্বর ২০১৭ সালে আসে ১১৬৩.৮২ মিলিয়ন বা বাংলাদেশী টাকার হিসেবে ৯৬০৮ কোটি টাকা। আবার জানুয়ারী ২০১৭ তে দেশে আসে ১০০৯.৪৭ মিলিয়ন ডলার বা ৭৯৬০.০০ কোটি টাকা। যা নিশ্চিতভাবেই আমাদের জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার মজুদকে শক্তিশালী করছে । এছাড়া চলতি অর্থ বছরের ২০১৭-১৮ এর জুলাই ২০১৭ থেকে ফেব্রুয়ারী ২০১৮ পর্যন্ত আট মাসে মোট ৯৪৬১.১৫ মিলিয়ন ডলার বা ৭৭১৮৯.০০ কোটি টাকা প্রবাসী ভায়েরা রেমিটেন্স হিসেবে নিজ দেশে প্রেরণ করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক রেমিটেন্স সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে প্রথম আট মাসে আসে ৯.৪৬২ বিলিয়ন ডলার বা ৭৭১৮৯.০০ কোটি টাকা। ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে ১২.৭৭ বিলিয়ন ডলার, ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে ১৪.৯৪ বিলিয়ন ডলার, ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে ১৫.৩২ বিলিয়ন ডলার, ২০১৩-২০১৪ অর্থ বছরে ১৪.২৩ বিলিয়ন ডলার, ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরে ১৪.৪৬ বিলিয়ন ডলার, ২০১১-২০১২ অর্থ বছরে ১২.৮৪ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১০-২০১১ অর্থ বছরে ১১.৬৬ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা রেমিটেম্স হিসেবে বাংলাদেশে আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক হিসেব মতে, বর্তমানে মোট বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয় ফেব্রুয়ারী ২০১৮ তে ৩৩.৩৭ বিলিয়ন ডলারে পৌছেছে এবং দক্ষিন এশিয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়ের নিরিক্ষে ভারতের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আমাদের সোনার বাংলাদেশ। যেখানে ভারতের মতো বৃহৎ অর্থনৈতিক দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯৩.৭৫ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৭ সালে ভারত রেমিটেন্স বাবদ ৬২.০০ বিলিয়ন ডলার আয় করে। যেখানে ভারতের চীর প্রতিদ্বন্দী পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ১৩.৬৯ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
মধ্যপ্রাচ্যে চরম অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করায় সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের বৈদেশিক রেমিটান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব বেশ লক্ষ্যনীয়। তবে মালেয়শিয়াসহ এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোতে বিশেষ করে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশে দক্ষ জনবল পাঠানোর মতো যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে বলে আমি মনে করি। এছাড়া দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার আলোকে নতুন নতুন বৈদেশিক শ্রম বাজার সৃষ্টি করে শ্রমিক ও দক্ষ পেশাজীবী প্রেরণের ব্যবস্থা করতে পারলে আগামী ২০২২ সালের মধ্যেই বার্ষিক ২০.০০বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স বাবদ আয় করার বিষয়ে আমি দ্বারুন আশাবাদী। তবে এক্ষেত্রে আমাদের সরকারের উচিৎ মানব সম্পদ রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য নতুন নতুন শ্রম বাজার খুজে ঝামেলা ছাড়াই সহজে দেশের শ্রমিকদের বিদেশে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া,যাতে প্রতি বছর অন্তত্য ৫ লাখ শ্রমিক ও পেশাজীবী কাজের জন্য বিদেশে যেতে পারে।
তবে আমাদের সম্মানিত হাসিনা সরকার ও প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনায় বৈদেশিক রেমিটেন্স প্রবাহ এবং বৈদেশিক মুদ্এরার মজুত এখন একটি শক্ত ভিত্তির উপর দাড়াতে সক্ষম হয়েছে। আশা করা যায় আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের বৈশ্বিক রপ্তানির পরিমাণ ৫৫.০০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হওয়ার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৬৭.০০ বিলিয়ন ডলার ও রেমিটেন্স প্রবাহ ২০-২৫ বিলিয়ন ডলারে পৌছাবে এবং ইতিবাচক বৈদেশিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের বেকারত্বের হার প্রত্যাশিতভাবে কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে।
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, ছোট চৌগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com

Comments

Popular posts from this blog

এক লিজেন্ডারী যুদ্ধবিমান এফ-১৪ টমক্যাট ফাইটার জেটঃ

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার দ্রুত বাস্তবায়ন আর কত দূরে ?

এবার আমেরিকার এফ-১৬ যুদ্ধবিমান পেতে যাচ্ছে তুরস্কঃ