রাশিয়ান এস-৪০০ ডিফেন্স সিস্টেন নিয়ে একটি সমকালীন ভাবনা।।

রাশিয়া সাম্প্রতিক সময়ে চীনের কাছে পূর্ব চুক্তি মোতাবেক অত্যাধুনিক লং রেঞ্জের এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ সারফেস টু এয়ার মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমের প্রথম চালান সরবরাহ করেছে। মুলত ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে চীন ৩.০০ বিলিয়ন ডলার মুল্যের ছয় ব্যাটলিয়ন এস-৪০০ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়ের চুক্তি সম্পন্ন করে এবং পূর্ব নির্ধারিত সিডউল মোতাবেক এবং নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা চাপ উপেক্ষা করে প্রথম চালান পাঠালো বলে মনে করা হচ্ছে।

রাশিয়ান সংবাদ সংস্থা ইতার তাসের তথ্যমতে, লেনিনগ্রাদ অঞ্চলের উস্ত-লুগ বন্দর থেকে দুটি জাহাজে করে এস-৪০০’র প্রথম চালান চীনে পাঠানো হয় এবং জাহাজ দুটিতে রয়েছে কমান্ড পোস্ট, রাডার স্টেশন, লাউঞ্চিং স্টেশন, এনার্জি ইকুইপমেন্ট এবং অন্যান্য সরঞ্জমাদি। তবে তৃতীয় জাহাজটি গত জানুয়ারি মাসে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার সময় ঝড়ের কবলে পড়লে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা পুনরায় রাশিয়ায় ফেরত আনা হয়েছে এবং চলতি গ্রীষ্মের যে কোন সময় আবার চীনকে তা নতুন করে সরবরাহ করা হতে পারে। এদিকে রাশিয়ান এস-৪০০ সারফেস টু এয়ার মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম ব্যবস্থাপনা ও কার্যকরভাবে পরিচালনার স্বার্থে একটি চাইনিজ টিমকে ইতোমধ্যেই উচ্চ পর্যায়ের প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে এস-৪০০ মেনুফ্যাকচারিং কর্পোরেশন।

চুক্তি অনুযায়ী চীন ভবিষ্যতে কোন অবস্থাতেই এস-৪০০ সিস্টেমের ক্লোন কপি করতে পারবে না। তবে, যাই হোক এখন দেখার বিষয়, ক্লোন কপিবাজ মাস্টার মাইন্ড চায়নারা আগামী কত বছরের মধ্যে এস-৪০০ এর সম জাতীয় এয়ার মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম এইচকিউ-০০৭ বা ডিএফ-৪২০ কিম্বা অন্য কোন নামে সার্ভিসে আনতে শুরু করে। রাশিয়া অবশ্য এস-400 এর ক্লোন কপি ঠেকাতে ব্যবহার করেছে উচ্চ প্রযুক্তির ইন্টিগ্রেইড নেগিয়েশন সিস্টেম। তাছাড়া এটা যেখানে থাকবে সেখানে রাশিয়ান স্যাটেলাইট সার্বক্ষণিক নজরদারী চালাবে এবং এটিতে এমন কিছু সিস্টেম লাগানো রয়েছে এর স্যডো কভার খুলা মাত্র রাশিয়ানরা টের পাবে এবং পাশাপাশি বহু অত্যাধুনিক টেকনলজি ও সফটওয়ার আছে যা কপি করা চীনের পক্ষে হয়ত সম্ভব নাও হতে পারে।

আসলে উচ্চ প্রযুক্তি সমৃদ্ধ রাশিয়ান এস-৪০০ সারফেস টু এয়ার মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমটি ২৮শে এপ্রিল ২০০৭ সালে সার্ভিসে আসলেও আজ অবধি কোন যুদ্ধক্ষেত্রে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়েছে বা শত্রুপক্ষের কোন বিমান বা মিসাইল কাউন্টার কিম্বা ইন্টারসেপ্ট করতে সক্ষম হয়েছে এমন কোন তথ্য উপাত্ত বা বাস্তব প্রমান আছে বলে আমার মনে হয় না। তাছাড়া রাশিয়া কিন্তু সর্বদা তাদের নিজস্ব অস্ত্র অবং মিলিটারি এন্ড ডিফেন্স সিস্টেমের সক্ষমতা নিয়ে অতিরঞ্জিত তথ্য উপাত্ত প্রচার ও প্রকাশ করে থাকে। যা অনেক সময় বাস্তবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নাও হতে পারে। তবে এস-৪০০ কার্যত রাশিয়ার পূর্বের এস-৩০০পিএমইউ-৩ সারফেস টু এয়ার মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমের উপর ভিত্তি করে ব্যাপক আপগ্রেডিং এবং নতুন প্রযুক্তি সংযোজনের মাধ্যমে ডেভেলপমেন্ট করা হয়েছে।

রাশিয়ান এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ ডিফেন্স সিস্টেমের পার ইউনিট কস্ট ৪০০.০০ মিলিয়ন ডলার। এখানে পার ইউনিট বুঝাতে (আর্টিলারী ব্যাটলিয়ন) ৮টি মিসাইল লাউঞ্চার, ১১২টি বিভিন্ন পাল্লার মিসাইল এবং পাশাপাশি কমান্ড এন্ড সাপোর্ট যান ও রাডার সিস্টেমের সমন্বয়ে গঠিত একটি ব্যাটলিয়নকে বুঝানো হয়ে থাকে। তাছাড়া এস-৪০০ এর অত্যাধুনিক ও শক্তিশালী রাডার সিস্টেম ১০ মিটার থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ কিলোমিটার দুরুত্ব পর্যন্ত ১০০টি টার্গেট সনাক্ত করতে সক্ষম এবং পাশাপাশি যুগৎপতভাবে ২৪-৩০টি টার্গেটে সরাসরি মিসাইল হিট করতে সক্ষম বলে মনে করা হয়। যদিও বিষয়টি নিরপেক্ষ কোন মাধ্যমে প্রমান করা সম্ভব নয়।

যাই হোক এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ সারফেস টু এয়ার মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমটি মুলত চার ধরনের মিসাইল ব্যবহার করে। যার মাধ‍্যমে এটি ৪০ থেকে ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিভিন্ন এরিয়াল টার্গেট সনাক্ত ও মিসাইল হিটিং এর মাধ্যমে ধ্বংস করতে পারে । তবে যদি এস-৪০০ এর ক্ষেত্রে ব‍্যালেস্টিক টার্গেট অথবা ব‍্যালেস্টিক মিসাইল ধংসের ব‍্যাপার আসে ,সেক্ষেত্রে কিন্তু মিসাইলের রেঞ্জ হয়ে যায় সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার। তবে আকাশে জেট ফাইটার ও ক্রুজ মিসাইল কিম্বা অন‍্যান‍্য এরিয়াল টার্গেটের ক্ষেত্রে এটি ২৫০ কিলোমিটার থেকে সর্বোচ্চ প্রায় ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত টার্গেটকে সরাসরি হিট বা ধ্বংস করতে সক্ষম। এক্ষেত্রে এস-৪০০ সিস্টেমের সর্বোচ্চ ৪০০ কিলোমিটার পাল্লার লেটেস্ট ইন্টারসেপ্ট মিসাইলটি হলো ৪০এন৬। যেটির তথ্য কার্যত ২০১৫ সালে প্রকাশ্যে আসে। তবে এস-৪০০ এর মুল ও আদর্শ অস্ত্র হলো ২৫০ কিলোমিটার পাল্লার দ্রুতগতির ৪৮এন৬ মিসাইলটি। যা ফাইনাল স্টেজে ম‍্যাক ১৪ গতিবেগে টার্গেটের দিকে ধেয়ে যায়। তাছাড়া এস -৪০০ সিস্টেমটি স্বল্প রেঞ্জের ৪০ কিলোমিটারের জন্য ৯এম৯৬ই মিসাইল এবং ১২০ কিলোমিটারের টার্গেট ধ্বংসের জন্য ৯এম৯৬ই২ মিসাইল ব্যবহার করে থাকে।

পরিশেষে বলা যায়, রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে সামরিক সহায়তার অংশ হিসেবে এবং সিরিয়ায় রাশিয়া তার নিজস্ব আকাশ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ২০১৬ সালের দিকে একাধিক গোপন ঘাঁটিতে এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েন করে। তবে আজ অবধি সিরিয়ার আকাশে একটি জেট ফাইটার কিম্বা মিসাইল শুড ডাউন বা ইন্টারসেপ্ট করতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে হয় না। যদিও রাশিয়ার প্রবল আপত্তি সত্তেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল একাধিকবার জেট ফাইটার বা টমাহক ক্রুজ মিসাইল বা অন্য মিসাইল দ্বারা সিরিয়ার আসাদ বাহিনীর সামরিক ঘাঁটিতে এক রকম নিয়মিত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। আবার এর আগে তুর্কী এফ-১৬ সিরিয়া সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় একটি রাশিয়ান এসইউ-২৪ বোম্বার শুড ডাউন করে বসে। সেখানে রাশিয়ান এস-৪০০ ডিফেন্স সিস্টেমের প্রতিক্রিয়াহীন ভাবে নিরবে বসে থাকাটা কিশ্তু ডিফেন্স সিস্টেমটির সক্ষমতা ও কার্যকারিতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। এক্ষেত্রে আবার সরাসরি সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য রাশিয়ার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের গোপন সামরিক চুক্তি, তথ্য বিনিময় এবং সমাঝোতা থাকার সমুহ সম্ভবনা থেকেই যাচ্ছে।

সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, ছোট চৌগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com

Comments

Popular posts from this blog

এক লিজেন্ডারী যুদ্ধবিমান এফ-১৪ টমক্যাট ফাইটার জেটঃ

ভারত ও চীনের সীমান্ত উত্তেজনা...

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার দ্রুত বাস্তবায়ন আর কত দূরে ?