বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার দ্রুত বাস্তবায়ন আর কত দূরে ?
বর্তমানে একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল প্রাণ হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা। আর বিজ্ঞান শিক্ষার প্রাণ হচ্ছে বাস্তব জীবন নির্ভর ও কার্যকর ব্যবহারিক বা প্রাক্টিক্যাল ক্লাস ও পরীক্ষা। যার বাস্তব প্রয়োগ ও ব্যবহার ছাড়া আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের এক বিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত করা কিংবা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এক কথায় অসম্ভব বলা চলে।
অথচ একবিংশ শতাব্দীর এই আধুনিক যুগে এসেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে আমাদের কেন জানি আজ হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমরা উন্নত বিশ্বের তুলনায় এখনো পর্যন্ত বিজ্ঞান শিক্ষায় অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছি। বিশেষ করে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, ইনোভেটিভ আইডিয়া কিংবা গবেষণামূলক কাজে নিজেদের কেন জানি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছি না।
বর্তমানে আমাদের দেশের গ্রামীণ ও সাধারণ মফস্বল এলাকায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং কলেজগুলোর কোন একটি শ্রেণিতে ৫০ জন শিক্ষার্থী থাকলে দেখা যায় যে, ৪২ জন মানবিক কিংবা বাণিজ্যিক বিভাগে এবং মাত্র শুধু ৮ থেকে ১০ জন কিংবা তারও কম শিক্ষার্থী বিজ্ঞান বিভাগের হয়ে থাকে। যা থেকে আসলে আমাদের দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার ৯০% ক্ষেত্রে এক নীরস ও মলিন চিত্র ফুটে উঠে।
তাছাড়া উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের সম্মানিত সরকার সার্বিক শিক্ষা খাতে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮৮,১৬২ কোটি টাকা বরাদ্দের পাশাপাশি সারা দেশে উন্নত মানের বিজ্ঞান ও ডিজিটাল ল্যাব গড়ে তুলেছেন এবং এখনো পর্যন্ত এই কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে হতাশার বিষয় হলো যে, আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের বাস্তব জ্ঞান নির্ভর দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জনে ৯০% এর ক্ষেত্রে তার কার্যকর ব্যবহার কিন্তু লক্ষ্য করা যায় না। আর এই হতাশাজনক প্রবণতা থেকে কিন্তু আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে।
আবার একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যবহারিক ক্লাস বা প্রাক্টিক্যাল পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিন্তু আমরা মোটেও সচেতন নই। বর্তমানে বিষয়টি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষার্থী এক দিকে নিজে পরীক্ষার হলে পরীক্ষা দিচ্ছে। আবার সেই পরীক্ষার্থীর ছয় থেকে আটটি ব্যাবহারিক বা প্রাক্টিক্যাল খাতা অন্য কেউ হয়ত হাজার টাকা বিনিময়ে এঁকে এবং লিখে দিচ্ছে।
এদিকে সেই ব্যাবহারিক খাতার উপর ভিত্তি করে এবং লোক দেখানো কিংবা অনেকটা দায় সারা গোছের ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীকে দেয়া হচ্ছে ৯০% থেকে ৯৫% কিংবা মুখ চেনা দেখে দেয়া হচ্ছে শতভাগ ফুল মার্কস। অথচ তারা অধিকাংশই হয়ত জানে না যে তাঁদের ব্যাবহারিক খাতায় ঠিক কি লেখা রয়েছে।
উদাহরণ স্বরূপ আবার প্রাক্টিক্যাল খাতায় মাইক্রোস্কোপের ছবি এঁকে বর্ণনা লিখা হলেও বাস্তবে সারা দেশের ৮০% শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ল্যাবে অধিকাংশ কমলমতি শিক্ষার্থীদের মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে এ কাজ দেখানো হয় না। এতে করে শিক্ষার্থীদের একরকম বাধ্য হয়ে মুখস্থ বিদ্যার উপর নির্ভর করে বিজ্ঞান ও ব্যবহারিক ক্লাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে শেষ করতে হয়।
এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী কিন্তু বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও গণিত বিষয়ের ব্যবহারিক সংক্রান্ত পর্যাপ্ত জ্ঞান, দক্ষতা দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন না করেই প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ বা এ+ পেয়ে যাচ্ছে অনায়াসেই। আবার এখান থেকে তারা উঠে আসছে একেবারেই উচ্চ শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরে। আর শিক্ষার্থীরা এভাবে সকল স্তরেই ভালো ফলাফল অর্জন করলেও বাস্তবে দেশ ও জাতির জন্য উপযোগী ও কল্যাণকর নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, উন্নয়ন ও গবেষণায় আমরা নিশ্চিতভাবেই পিছিয়ে রয়েছি।
তবে এটা ঠিক যে, আমাদের দেশে ছড়িয়ে থাকা শতাধিক ভালো মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর বিষয়গুলো স্টাডি করানো হয়। তার পাশাপাশি এক রকম নিয়মিতভাবে ক্লাসেই ব্যবহারিক ক্লাসগুলো ল্যাবে পরিচালনা করা হয়ে থাকে। এখানে শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই তাদের জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি বেশ ভালো ভাবেই অর্জন করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে সন্দেহের কোন অবকাশ না থাকলেও বাস্তবে খুবই ভালো মানের সংখ্যা কিন্তু মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০% থেকে ১৫% এর অধিক হয়ত হবে না।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে চলমান এই প্রবণতা থেকে বেড়িয়ে আসতে আমাদের দেশের প্রণয়ন করা হয়েছে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম। যার আলোকে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে বাস্তব জীবন নির্ভর শিক্ষা দানের পাশাপাশি উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বান্ধব শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে। তার পাশাপাশি সকল সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে উঠে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী নির্ভর দলীয় ব্যবহারিক কাজ, একক কাজ এবং লিখিত পরীক্ষা সমন্বয়েই নতুন করে সাজানো হচ্ছে শিক্ষা কারিকুলামকে। যার চূড়ান্ত ও ইতিবাচক সুফল আমরা হয়ত আগামী ৫ থেকে ৮ বছরের মধ্যেই পেতে শুরু করব বলে প্রত্যাশা করা যায়।
সিরাজুর রহমান Sherazur Rahman, সহকারী শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ।
Comments
Post a Comment