আবারো নতুন করে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের মুখে ইউক্রেন এবং তার ভবিষ্যতঃ
আশির দশকে দীর্ঘ মেয়াদী আফগান যুদ্ধের ধকল সইতে না পেরে এবং ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ১৯৯১ সালে কোল্ড ওয়ার যুগের অবসান ঘটিয়ে তৎকালীন বিশ্বের প্রধান সামরিক সুপার পাওয়ার সভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে বেশকিছু নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। সভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্তি হয়ে রাশিয়া, ইউক্রেন, উজবেকিস্তান, জর্জিয়া, কাজাখাস্তান, আর্মেনিয়া, তুর্কমেনিস্তান, বেলারুশ, আজারবাইজানসহ মোট ১৫টি নতুন স্বাধীন সার্বোভৌম দেশের জন্ম হয়। তৎকালীন পরাক্রমশালী সভিয়েত ইউনিয়নের হাতে ১০ হাজারের কাছাকাছি নিউক্লিয়ার এণ্ড থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্রের বিশাল মজুত থাকলেও (ইউএসএসআর) ফেডারেশন ভেঙ্গে গেলে তাদের নিউক অস্ত্রে একটি বড় অংশ ইউক্রেন এবং কাজাখাস্তানের মতো বেশ কিছু দেশের হাতে থেকে যায়। তবে এই পারমাণবিক অস্ত্রের ৮০% পর্যন্ত রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তখন ইউক্রেনের অধিকারে মোট ১,৯০০টি নিউক্লিয়ার অস্ত্র ও ওয়ারহেড, ১৭৬টি ইন্টারকন্টিন্যান্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল এবং ৪৪টি স্ট্যাটিজিক বোম্বার বিমান ছিল। যা কিনা দেশটিকে সেই সময়ে বিশ্বের বুকে তৃতীয় সর্বোচ্চ কৌশলগত নিউক্লিয়ার অস্ত্রের অধিকারী দেশে পরিণত করেছিল।
তবে স্বাধীনতা অর্জন করার পর পরই ইউক্রেন তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সকল নিউক্লিয়ার
অস্ত্র জাতিসংঘের সহায়তায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে ধ্বংস কিংবা
অন্য কারো কাছে হস্তান্তর করে দেয় এবং তাদের হাতে থাকা সকল ধরণের ইন্টারকন্টিন্যান্টাল
ব্যালেস্টিক মিসাইল পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলা হয়। আর তাদের বহরে থাকা ৪৪টি বোম্বার অযত্ন
এবং নিয়মিত রিপিয়ার মেইন্টেনেন্সের অভাবে চীর দিনের মতো গ্রাউন্ডেড বা অকেজো হয়ে খোলা
আকাশের নিচে পরে থাকে এবং ভাগে পাওয়া হাজার হাজার মেইন ব্যাটল ট্যাংক এখনো পর্যন্ত
খোলা মাঠে অকেজো হয়ে জং ধরে পড়ে রয়েছে।
আসলে ইউক্রেনের হাতে থাকা বিশাল আকারের পরমাণু অস্ত্র ভান্ডার মাফিয়াদের
হাতে চলে যাওয়ার মতো বিপদজনক পরিস্থিতির সৃষ্টির সমুহ সম্ভবনা ছিল। আর তাই ঝুঁকি এঁরাতে
ইউক্রেনের নিউক্লিয়ার অস্ত্র জরুরী ভিত্তিতে ধ্বংস এবং নির্ভরযোগ্য তৃতীয় কোন দেশের
কাছে হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিলো জাতিসংঘ। অবশ্য এর জন্য ইউক্রেন কয়েক বিলিয়ন
ডলারের অর্থিক সহায়তা ও বৈদেশিক ঋণ প্যাকেজ লাভ করে। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে অস্ত্র
ধ্বংস করা হলেও ইউক্রেন কিন্তু একেবারেই স্বেচ্ছায় তার হাতে থাকা প্রাণঘাতী নিউক্লিয়ার
অস্ত্র পরিত্যাগ করে।
অথচ এদিকে কিনা শান্তি প্রিয় দেশ হিসেবে নিজেকে প্রমান করতে গিয়ে ইউক্রেন
আজ আবারো রাশিয়ার ভয়াবহ সামরিক আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে। তাছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত
দেশগুলোর সাথে অতি মাত্রায় সখ্যতা তৈরি করায় রাশিয়ার বিরাগভাজন হতে হয়েছে ইউক্রেনকে।
রাশিয়ার পুতিন প্রশাসন ইতোমধ্যেই স্বাধীন দেশ ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চল গায়ের জোরে
অনেক আগেই দখল করে বসে আছে। আর এখন সম্পূর্ণ দেশটাকেই ধ্বংস এবং দখলের হুমকী দিয়ে যাচ্ছে
প্রতিনিয়ত। তারই ধারবাহিকতায় রাশিয়ার পুতিন বাহিনী ইউক্রেনের সীমান্ত জুড়ে বড় ধরণের
সামরিক সমাবেশ করেছে এবং এতদ অঞ্চলে চরম সামরিক উত্তেজনা বিরাজ করছে।
এখানে প্রকাশ থাকে যে, ইউক্রেন যদি তার হাতে থাকা নিউক্লিয়ার অস্ত্রের মাত্র
৫% গোপনে হলেও নিজ অধিকারে রাখত কিংবা সংরক্ষণ করত, তাহলে রাশিয়া তো দূরের কথা বিশ্বের
কোন দেশই ইউক্রেনের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস পেত কিনা সন্দেহ এবং রাশিয়ার সামরিক
আগ্রাসন ও শোচনীয় অবস্থা তাদের দেখতে হতো না। সেই সময়ে মাত্র ২ কিংবা ৩ বিলিয়ন ডলারের
অর্থিক সহায়তা বা ঋণ প্রাপ্তির আশায় এবং নিজেকে শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে প্রমাণ করতে
ইউক্রেন আসলে অতীতে যা করেছে তার জন্য কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিণতি বরণ করতে
হতে পারে। এমনকি ইউক্রেনের স্বাধীনতা চরমভাবে বিপর্যস্ত হতে পারে। যার আলামত এখনই কিন্তু
শুরু হয়ে গেছে। যদিও অবশ্য তুরস্ক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো এগিয়ে আসায়
রাশিয়ার পক্ষে আপাতত দৃষ্টিতে খুব সহজেই ইউক্রেন দখল করতে পারবে বলে মনে হয় না।
১৯৯১ সালের পরবর্তী সময়ে ইউক্রেন এবং রাশিয়া পাশাপাশি দুটো দেশ বন্ধুভাবাপন্ন
ছিল এবং দীর্ঘ সময় ব্যাপী অত্র অঞ্চলে কোন ধরণের সংঘাত ছিল বলে মনে হয় না। তবে ন্যাটোজোট
এবং ইউরোপীয় কিছু দেশের সহযোগীতায় ফ্যাসিস্ট ইউক্রেনিয়ান সামরিক বাহিনীর কিছু অংশ ইউক্রেনের
নির্বচিত সরকারকে উৎখাত করার পর থেকেই দেশ দুটির মধ্যে বৈরিতা এবং সামরিক উত্তেজনা
চরম আকার ধারণ করে। অবশ্য এজন্য পশ্চিমা বিশ্ব অনেকটাই দায়ী বলে মনে করা হয়। তাছাড়া
বিনা উস্কানীতে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে নিলে অত্র অঞ্চলের সার্বিক
পরিস্থিতি চরম অবনতির দিকে চলে যায়। আর এখন কিনা রাশিয়া এবং ইউক্রেন একে অপরের বিরুদ্ধে
মুখোমুখি অবস্থান করছে।
তবে এটা ঠিক যে, ইউক্রেন তাদের নিউক্লিয়ার অস্ত্র ধ্বংস, ট্যাকটিকাল অস্ত্রগুলো বিক্রি অথবা গ্রাউন্ডেড করে বিশাল অঙ্কের ঋণ এবং অর্থিক সহায়তা লাভ করে। যা তাদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সাহায্য করে। আর ন্যাটো জোট ভুক্ত দেশগুলোর সাথে সহযোগিতামূলক চুক্তিতে থাকায় এবং ভবিষ্যতে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের শিকার হলে ন্যাটো জোট ইউক্রেনকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে বলে তাদের বিশ্বাস ছিলো। তবে বর্তমান পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে তীব্র প্রতিবাদ করা ছাড়া ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার মতো কোন শক্ত অবস্থানে আছে বলে মনে হয় না। যদিও তুরস্ক ইতোমধ্যেই অজানা সংখ্যক কমব্যাট ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনকে সরবরাহ করেছে এবং মার্কিন সুপার বোম্বার এবং যুদ্ধজাহাজগুলো পরিকল্পনা মাফিক রাশিয়ার কাছাকাছি অঞ্চলে অবস্থান নিতে এগিয়ে যাচ্ছে। তার সাথে বেশকিছু তুর্কী এবং মার্কিন সামরিক বিশেষজ্ঞ টিম এখন ইউক্রেনে অবস্থান করছে রাশিয়াকে মোকাবেলা ও সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য।
সিরাজুর রহমান, সহকারী শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com
Comments
Post a Comment