তুরস্কের সাম্প্রতিক উত্থান এবং ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ নিয়ে একটি বিশ্লেষণঃ



উন-বিংশ শতাব্দীর বিশ্ব পরাশক্তি অটোমান সম্রাজ্য বা উসমানীয় খেলাফতের দেশ তুরস্ক আবারো বিশ্বের বুকে সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করেছে। বর্তমানে বৈশ্বিক বেশ কিছু সমর নীতিতে বিশ্ব পরাশক্তিধর দেশগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে নিজস্ব সামরিক সক্ষমতা ও কূটনৈতিক দক্ষতা প্রকাশে কোন রকম দ্বিধা করছে না দেশটি। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক কিন্তু যথেষ্ঠ সামরিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং যোগ্যতা অর্জন না করেই বিশ্বের প্রথম সারির সুপার পাওয়ার দেশগুলোর সাথে বিপদজনকভাবে সামরিক উত্তেজনা এবং বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে।

 

বিশেষ করে ভূমধ্যসাগরে বিতর্কিত সামুদ্রিক জলসীমায় তেল গ্যাস অনুসন্ধানকে কেন্দ্র করে তুরস্কের সাথে গ্রীস এবং সাইপ্রাসের বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে। আর উভয় পক্ষের অনড় অবস্থান ও বৈরি নীতির কারণে বর্তমানে গ্রীসের সাথে ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। যা কিনা অদূর ভবিষ্যতে পরোক্ষভাবে হলেও সম্রাজ্যবাদী গোটা ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ভয়ঙ্কর হুমকীতে রয়েছে দেশটি। অথচ বর্তমান অবস্থার পরিপেক্ষিতে সামরিক সক্ষমতা ও যোগ্যতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা রাশিয়া তো দূরের কথা এমনকি ইউরোপের প্রভাবশালী দেশ ফ্রান্সের ধারে কাছেও নেই সুলতান খ্যাত এরদোয়ানের দেশ তুরস্ক।

 

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কমব্যাট এণ্ড নন-কমব্যাট ড্রোন (ইউএভি), মিসাইল এণ্ড লাইট ডিফেন্স সিস্টেম নির্ভর প্রযুক্তিগত উন্নয়নে ব্যাপক সফলতা অর্জন করলেও তা কিন্তু সামগ্রিকভাবে তুরস্কের সামরিক সক্ষমতা এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বিশ্বের সুপার পাওয়ার দেশগুলোর পর্যায়ে পড়ে কিনা তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ঠ অবকাশ থেকেই যাচ্ছে। তাছাড়া বর্তমানে তুরস্ক একাধারে বিশ্বের বেশ কিছু সক্রিয় রণাঙ্গনে যেমন সিরিয়া, লিবিয়া এবং আজারবাইজানে-আর্মেনিয়া যুদ্ধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে। তুরস্ক নিজেও একটি ন্যাটো জোটভুক্ত দেশ হওয়া সত্ত্বেও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ন্যাটোভুক্ত অন্যান্য দেশগুলোর সাথে বৈরিতা এবং চরম বিবাদ।

 

আসলে তুরস্কের যে সামরিক সক্ষমতা এবং অভিযান আজ থেকে আগামী ১০ বছর পর দেখানো উচিত ছিল, তারা কিন্তু তা বিবেচনায় না এনেই মধ্যম মাত্রায় সামরিক সক্ষমতা নিয়ে শক্তিশালী দেশগুলোর সাথে চরম মাত্রায় বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। অথচ অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতার বিচারে ইউরোপের দেশ গ্রীস তুরস্ক অপেক্ষা অনেকটাই পিছিয়ে থাকলেও ভবিষ্যতে যে কোন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে গ্রীসকে ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলো সরাসরি সমর্থন দানের পাশাপাশি নির্বিচারে অস্ত্র সরবরাহে কোন রকম ত্রুটি রাখবে বলে মনে হয় না। আর এখনই কিন্তু ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলো জোট বেঁধে গ্রীসকে পূরো মাত্রায় সমর্থন দিতে শুরু করে দিয়েছে এবং অত্যন্ত গোপনে তুরস্ক বিরোধী কার্যকলাপে এগিয়ে যাচ্ছে।

 

এদিকে বিশেষ করে আমেরিকা ও ইউরোপের খ্রিষ্টান সমাজ আজ তুরস্কের সাথে গ্রীসের সামরিক বিবাদকে কিন্তু মধ্যযুগের ক্রুসেড যুদ্ধের সাথে বিবেচনা করে তা যে কোন মূল্যেই হোক রণাঙ্গনে তুরস্ককে কার্যকরভাবে প্রতিহত করার নীতি ও কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই কারো উস্কানীতে কিংবা অতি মাত্রায় উৎসাহী হয়ে গ্রীস বা আর্মেনিয়ার সাথে যুদ্ধ জড়িয়ে পড়লে বর্তমান অবস্থার পরিপেক্ষিতে তুরস্ক বড় ধরণের সামরিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যেতে পারে। এমনো হতে পারে যে, শত বর্ষব্যাপী চাপিয়ে দেয়া অতীতের অন্যায় লুজিয়ান চুক্তির শৃঙ্খল বা বেড়া জাল থেকে বের হতে না হতেই প্রাশ্চাত্যের কূটকৌশলী শক্তিগুলো আবারো একত্র হয়ে তুরস্কের উপর আরো ভয়ঙ্কর এবং বিপদজনক নতুন কোন নিষেধাজ্ঞা বা বৈশ্বিক বাধা নিষেধ চাপিয়ে দেয়।

 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর ১৯২৩ সালের ২৪শে জুলাই লুজিয়ান চুক্তির মাধ্যমে অতীতের উসমানীয় খেলাফতকে সম্পূর্ণ বিলুপ্তি করে তুরস্ককে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে ফেলে রাশিয়া ও ইউরোপীয় দেশগুলো এবং উসমানী খেলাফতের আফ্রিকা, মধ্যপ্রচ্য, এশিয়া এবং ইউরোপের সুবিশাল অঞ্চলগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নিতে কোন রকম কার্পন্য করেনি ফ্রান্স, স্পেন, যুক্তরাজ্য এবং তৎকালীন বিশ্ব পরাশক্তি সভিয়েত ইউনিয়ন। যা কার্যকর হয় ৬ই আগস্ট ১৯২৪ সালে। আর ২০২৩ সালের ২৪শে জুলাই অতীতের এই অপমানজনক লুজিয়ান চুক্তির শতবর্ষ পূর্ণ হতে যাচ্ছে। যদিও মনে করা হয় শত বর্ষব্যাপী ও মেয়াদহীন এই লুজিয়ান চুক্তির শৃঙ্খল থেকে মুক্তি নিয়ে আবারো নতুন এক যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে তুরস্ক। তাই অনেকটা কৌশলগত কারণে এবং নিজ প্রয়োজনে তুরস্কের এরদোয়ান সরকারকে আপাতত স্পর্শকাতর একাধিক বৈশ্বিক ইস্যুতে নিশ্চুপ থাকা উচিত বলেই আমি মনে করি। এক্ষেত্রে ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছ থেকে যতটা সম্ভব প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জন করে হোক কিংবা চীনের মতো হাতিয়ে নিয়ে হলেও নিজস্ব সামরিক প্রযুক্তি ও শিল্পকে আরো আধুনিক এবং এক বিংশ শতাব্দীর নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আরো শক্তিশালী করে গড়ে তোলার দিকে যতটা সম্ভব মননিবেশ করাই এখন তুরস্কের মূলমন্ত্র হওয়া দরকার। পাশাপাশি কৌশলে নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি অর্জন এবং বিশ্ব পরাশক্তিধর দেশগুলোর কাতারে নিজেকে নিয়ে যাওয়ার বিকল্প কিছু থাকতে পারে বলে মনে হয় না।

 

এদিকে দুই দশক ধরে রাশিয়াকে কৌশলগতভাবে প্রতিহত করার জন্য তুরস্কের ইন্সিরলিক মার্কিন বিমান ঘাটিতে ৫০টি বা তার কাছাকাছি বি-৬২ নিউক্লিয়ার অস্ত্র মজুদ থাকলেও তা কিন্তু সম্পূর্ণভাবে মার্কিন সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যা ব্যাবহারের অধিকার কিংবা সুযোগ কোনটাই তুরস্কের সামরিক বাহিনীর নেই এবং তুরস্ক নিজেও কিন্তু কোন নিউক্লিয়ার অস্ত্র সমৃদ্ধ দেশ নয়। অনেকেই প্রচার করে থাকেন যে, মার্কিন প্রশাসন তুরস্ককে তাদের সামরিক ঘাঁটিতে থাকা নিউক্লিয়ার অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ দিয়ে রেখেছে। যা কার্যত একটি মিথ্যা গুজব বা বানোয়াট তথ্য ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ তুরস্ক এ মুহুর্তে চুপ না থেকে মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া এবং ইরাক, আফ্রিকায় লিবিয়ায় এবং পূর্ব ইউরোপে বেশ কিছু দেশের সাথে সমুদ্র সীমানা নিয়ে বিবাদ ও সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে কার্যত নিজেকেই বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে এবং পাশাপাশি ভবিষ্যতে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে নতুন প্রযুক্তি ও সামরিক সহযোগিতা প্রাপ্তির পথটিও আজ কিন্তু এক রকম বন্ধ হবার পথেই বলা চলে।

 

তাছাড়া বৈশ্বিক সামরিক সক্ষমতার বিচারে তুরস্কের নেভাল এণ্ড গ্রাউণ্ড ফোর্স যথেষ্ঠ আধুনিক ও শক্তিশালী বলে মনে করা হলেও বাস্তবে তা কিন্তু কোন ভাবেই ইউরোপের ফ্রান্স, জার্মান বা যুক্তরাজ্যের সমপর্যায়ে পড়ে না। আবার দেশটির বিমান বাহিনীতে যুদ্ধবিমান হিসেবে মাত্র ২৪৫টি এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকন এবং ষাটের দশকের ৪৮টি এফ-৪ ফ্যান্টম-২ ছাড়া আর কিছুই নেই। অন্যদিকে মুল ভরসা হিসেবে তুরস্কের হাতে থাকা শতাধিক কমব্যাট ড্রোন রয়েছে। যা অতি স্পর্শকাতর এবং ভয়াবহ যুদ্ধে একটি গেম চ্যাঞ্জেজার হিসেবে কাজ করতে পারে। তাছাড়া সিরিয়া এবং লিবিয়ার আকাশে তুর্কী ড্রোন রাশিয়ার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ধ্বংস করে বিশ্বের সামনে তার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও দক্ষতার প্রমান বেশ কয়েক বার দিয়ে রেখেছে। 

 

অথচ সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের সাথে গ্রীসের সামরিক উত্তেজনার পেক্ষাপটে ফ্রান্স সামরিক সহায়তার অংশ হিসেবে গ্রীসকে ১৮টি এডভান্স রাফায়েল জেট ফাইটার দিতে যাচ্ছে। যার মধ্যে কিনা ৮টি একেবারেই ফ্রীতে দিতে যাচ্ছে ফ্রান্স। তাছাড়া গ্রীস নিজেই একটি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিহীন এবং পিছিয়ে পড়া একটি দেশ হলেও তার পাশে গোপনে কাজ করে যাচ্ছে গোটা ইউরোপ এবং আমেরিকা। অন্যদিকে ভবিষ্যতে যে কোন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে তুরস্ককে সামরিক সহায়তা বা পাশে দাঁড়াবার মতো আদৌ কোন শক্তিধর দেশ বা পরাশক্তি আছে কিনা সন্দেহ। তবে এক্ষেত্রে বিশ্ব পরাশক্তি চীন এবং রাশিয়া তুরস্ককে সামরিক সহায়তায় হাত বাড়িয়ে দেবার প্রবল সম্ভবনা থাকলেও বাস্তবে আসলে তা কতটুকু সম্ভব হবে তাও কিন্তু নিশ্চিত নয়।

 

হাস্যকর হলেও সত্য যে, তুরস্কের নব্য উত্থান এবং মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারে ভবিষ্যতে ক্ষমতা হারানোর ভয়ে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত বা ভীত হয়ে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যের বাদশা আমীর শাসিত বেশ কিছু আরব দেশ। আর তাই যে কোন ভাবেই হোক তুরস্কের নব্য উত্থান কিংবা সামরিক প্রভাব খর্ব করতে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরবের দিক নির্দেশনায় আরব আমিরাত এবং মিশর কিন্তু ইতোমধ্যেই গ্রীসের সাথে হাত মিলিয়েছে। এখানে প্রকাশ থাকে যে, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরান এবং মিশর নিজেরাই একটি আঞ্চলিক অক্ষশক্তি হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করে যাচ্ছে। খুব সম্ভবত আরব আমিরাত ও মিশর সামরিক সহায়তার অংশ হিসেবে গ্রীসে গোপনে যুদ্ধবিমান এবং সামরিক সাজ সরঞ্জাম পাঠিয়েছে কিংবা পাঠাতে যাচ্ছে ভূমধ্যসাগরে তুরস্ককে সামরিক দিক দিয়ে মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে।

 

এদিকে লিবিয়ায় জাতিসংঘ সমর্থিত জিএনএ সরকারকে সামরিক সহায়তার অংশ হিসেবে তুরস্ক এগিয়ে আসলেও তুরস্কের সেনাবাহিনী এবং জিএনএ সরকারকে উৎখাত করে গোটা লিবিয়ার দখল নিতে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মিশর, ফ্রান্স এবং সর্বপরি রাশিয়া একত্র হয়ে লিবিয়ায় বিরোধী মিলিশিয়া গ্রুপ হাফতার বাহিনীকে নির্বিচারে অর্থ এবং অস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি রাশিয়া খুব সম্ভবত সিরিয়া থেকে হাজারের কাছাকাছি ভাড়াটে সেনা পাঠিয়েছে লিবিয়ায় হাফতার বাহিনীর পক্ষে অর্থের বিনিময়ে যুদ্ধ করতে। যার ব্যয়ভার গোপনে বহন করবে সৌদি ও তার জোট। তাছাড়া সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের ইস্যুতে বর্তমানে রাশিয়ার সাথে তুরস্কের চরম উত্তেজনা চলছে এবং রাশিয়া থেকে এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়ের ইস্যুতে মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে তুর্কী এরদোয়ান সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্ক একেবারে তলানীতে এসে ঠেকেছে।

 

বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সালে এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়ের শাস্তি স্বরুপ তুরস্ককে এফ-৩৫ স্টিলথ জেট ফাইটার প্রজেক্ট থেকে বের করে দেয়। অথচ তুরস্ক কিন্তু লকহীড মার্টিন কর্পোরেশনের মাল্টি বিলিয়ন ডলারের এফ-৩৫ প্রজেক্টের একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং খুব সম্ভবত তুরস্কের ডিফেন্স রিলেটেড ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাবগুলো হাজারের কাছাকাছি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ, ডিভাইস এবং কীট সরবরাহকারী হিসেবে এখনো পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছে। তাছাড়া এই প্রজেক্টে তুরস্কের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় ২.২৫ বিলিয়ন ডলার। অথচ এখন কিনা এস-৪০০ বিবাদে জড়িয়ে আজ তুরস্ক এফ-৩৫ প্রজেক্টের যাবতীয় সুবিধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে গেল।

 

এদিকে পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক তুরস্কের বিমান বাহিনীর জন্য সদ্য প্রস্তুতকৃত ৮টি এডভান্স এফ-৩৫এ সিরিজের স্টিলথ জেট ফাইটার তুরস্ককে না দিয়ে মার্কিন বিমান বাহিনী ক্রয় করে নিয়েছে। যার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৬২ মিলিয়ন ডলার এবং যা কিনা প্রাথমিকভাবে তুরস্কের নিজস্ব চাহিদা মাফিক কাস্টমাইজড করে তৈরি করা হয়েছিল। অবশ্য ভবিষ্যতে তুরস্ককে আবারো এফ-৩৫ প্রজেক্টে অন্তভুক্ত করা নিয়ে আলোচনাব শুরু করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে মার্কিন প্রশাসন। যদিও এদিকে তুরস্ক তার নিজস্ব প্রযুক্তির নতুন প্রজন্মের টিএফ-এক্স জেট ফাইটার প্রজেক্ট নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ২০২৫ সালের দিকে এর প্রটোটাইপ কপির আকাশে উড্ডয়নের বিষয়ে তুরস্ক প্রবল আশাবাদী হলেও নতুন প্রজন্মের টিএফ-এক্স স্টিলথ জেট ফাইটার প্রজেক্টের ম্যাসিভ প্রডাকশন লাইন আগামী ২০৩০ এর আগে চালু করা নিয়ে অনিশ্চয়তা  দেখা দিয়েছে। তাই সব দিক বিবেচনায় তুরস্ককে কমপক্ষে ২০৩০ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক পরাশক্তিধর দেশগুলোর সাথে বিরোধে না জড়িয়ে এবং যতটা সম্ভব সখ্যতা বজায় রেখে নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা সুসংহত করার পাশাপাশি নিজস্ব সামরিক সক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বিশ্ব পরাশক্তিধর দেশগুলোর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে অধিক গুরুত্ব প্রদানের নীতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার বিকল্প কিছু থাকতে পারে বলে মনে হয় না।

যদিও তুরস্কের সামরিক বাহিনী কিন্তু এরই মধ্যে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বা প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় কয়েক ধাপ এগিয়ে রয়েছে। বিশেষ করে সিরিয়া এবং লিবিয়ায় বিশ্বের কিছু সুপার পাওয়ার দেশগুলোর সম্রাজ্যবাদী ও আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে দেশটি। নিজেদের অর্থনীতি সক্ষমতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে প্রয়োজনে কৃষ্ণ সাগর এবং লোহিত সাগরে তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে তুরস্ক। এরইমধ্যে কৃষ্ণ সাগরে নিজেদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গ্যাসের খনিজ আবিষ্কার করে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে দেশটি। তাছাড়া সাইপ্রাস ও গ্রীসের সাথে সামরিক উত্তেজনায় মুখে নুন্যতম কোন ছাড় দিতে আগ্রহী নয় তুর্কী এরদোয়ান সরকার এবং এক্ষেত্রে দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বিশেষ করে পরমাণু শক্তিধর ফ্রান্সের সম্রাজ্যবাদী চোখ রাঙ্গানীকে মোটেও পাত্তা দিচ্ছে না।

 

এদিকে গত মাসে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে তুর্কী নৌবাহিনীতে নতুন প্রতিরক্ষা ও প্রশিক্ষণ সাজ সরঞ্জাম সংযুক্ত করার এক অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েব এরদোয়ান বলেন, ‘তুরস্ক নতুন উদ্যোমে সামরিক ও প্রতিরক্ষা শিল্পখাতকে খুব দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি অর্জনের মাধ্যমে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আরো বেশি মনোযোগ দিচ্ছি আমরা।’

 

মুলত এই অনুষ্ঠানের মাধম্যে দেশটির নৌ-বাহিনীতে নতুন করে প্রশিক্ষণ রণতরী, দুটি সাবমেরিন, আটটি টহল জাহাজসহ কিছু জরুরি ব্যবহারের জন্য দুটি বিশেষ যান এবং সামরিক সাজ সরঞ্জাম আনুষ্ঠানিকভাবে কমিশনিং ও হস্তান্তর করা হয়। তাছাড়া একেবারে নিজস্ব প্রযুক্তির যুদ্ধ জাহাজ নির্মাণে বিশ্বের বুকে সেরা দশটি দেশের মধ্যে নিজিরবিহীনভাবে তুরস্ক তার যোগ্য স্থান করে নিয়েছে।

 

তাছাড়া অনুষ্ঠানে এরদোয়ান আরো বলেন, ‘তুরস্ক আন্তর্জাতিক আইন মেনে নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির কাজ অব্যাহত রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। অদূর ভবিষ্যতে যেকোনো মূল্যে সামরিক শক্তিতে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী নিয়মিতভাবে বৃদ্ধি করা হবে। প্রতিরক্ষাখাতে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ছাড়া আগামীর বিশ্বে নিজেদের অবস্থান জানান দেয়া সম্ভব নয়। তাই বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামরিক প্রতিরক্ষায় প্রযুক্তিগত উন্নয়নের বিকল্প নেই। প্রতিরক্ষা শিল্পে নিয়মিত কার্যক্রম আরো বেশি শক্তিশালী করা হবে। আগামীতে নিজস্ব প্রয়োজন মাফিক আরো উন্নত প্রযুক্তির সামরিক সাজ সরঞ্জাম ও অস্ত্র উৎপাদন করে যাবে তুরস্ক।’

 

আসলে তুরস্ক সামরিক প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষা শিল্পে বর্তমানে কতটুকু অগ্রগতি বা সাফল্য অর্জন করেছে তা জানা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডিফেন্স নিউজ ম্যাগাজিন’ সদ্য প্রকাশিত প্রতিরক্ষা শিল্প ভিত্তিক এক প্রতিবেদনে। চলতি ২০২০ সালের ১৭ই আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সামরিক এবং প্রতিরক্ষা বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘ডিফেন্স নিউজ ম্যাগাজিন’ বিশ্বের সর্বোচ্চ রেভিনিউ অর্জনকারী ১০০টি ডিফেন্স রিলেটেড ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কর্পোরেশন এবং কোম্পানির তালিকা প্রকাশ করে। আর এই তালিকায় বরাবরের মতো প্রথম পাঁচটি কর্পোরেশনসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট ৫০টি ডিফেন্স এণ্ড মিলিটারি রিলিটেড ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কর্পোরেশন বা কোম্পানি জেয়গা করে নিলেও তালিকায় সামরিক ও প্রতিরক্ষা শিল্পে তুরস্কের নব্য উত্থান এবং অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো ছিল।

 

বিশেষ করে এই এলিট ক্লাবের তালিকায় থাকা বিশ্বের একমাত্র মুসলিম দেশ হিসেবে তুরস্ক তার যোগ্য স্থান করে নিয়েছে। ডিফেন্স নিউজ ম্যাগাজিনের তথ্যমতে, ২০১৯ নীট রেভিনিউ বা রাজস্ব আয়ের পরিমাণ কম হলেও তুরস্কের মোট ৭টি ডিফেন্স রিলেটেড ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কর্পোরেশন বা কোম্পানি তাদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। বিশেষ করে, তুর্কী এ্যাসেলসান কর্পোরেশন ২০১৯ সালে ২.১৭৩ বিলিয়ন ডলার রেভিনিউ অর্জন করে ৪৮তম স্থানে চলে এসেছে। যেখানে ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি ৫২তম স্থানে ছিল। তাছাড়া ১.৮৬ বিলিয়ন ডলার আয় করে তার্কিস এ্যারোস্পেস ইণ্ডাস্ট্রিজ ৫৩তম স্থানে, ৫৩৪.০০ মিলিয়ন ডলার আয় নিয়ে তুর্কী বিএমসি অটোমটিভ লিমিটেড ৮৯তম স্থানে, ৫১৫.০০ মিলিয়ন ডলার আয় নিয়ে রকেটসান ৯১তম স্থানে, ৪৮৫.০৮ মিলিয়ন ডলার আয় নিয়ে এসটিএম ৯২তম স্থানে, তুর্কী এফএনএসএস ৩৭৪.৯৪ মিলিয়ন ডলার আয় করে ৯৮তম স্থানে এবং তুর্কী হাভিলসান কোম্পানি ২৯৫.৬১ মিলিয়ন ডলার আয় করে ৯৯তম স্থানে চলে এসেছে। তাছাড়া মুসলিম বিশ্বের অন্য কোন দেশ এই এলিট ১০০ কোম্পানির তালিকায় স্থান করে নিতে পারেনি।

 

তাছাড়া ২০১৯ সালে তুরস্ক আনুমানিক মোট ২.৭২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক সাজ সরঞ্জাম আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করেছে এবং আগামী ২০২৫ সালে মধ্যে প্রতিরক্ষা শিল্পখাত থেকে বৈশ্বিক রপ্তানির পরিমাণ ৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশটির সামরিক ও প্রতিরক্ষা শিল্পখাত। অন্যদিকে তুরস্ক ২০১৯ সালে বৈশ্বিক অস্ত্র বাজার থেকে অস্ত্র আমদানি ৪৮% কমিয়ে এনেছে।

 

বর্তমানে তুরস্কের জিডিপি ৭৫০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হলেও দেশটির দীর্ঘ মেয়াদী ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল আকারের বৈদেশিক ঋন ও বোঝা সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করছে। প্রতি বছর দেশটির মোট আয়ের ও জিডিপির একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে বৈদেশিক ঋন ও তার সুদ বাবদ পরিশোধে। যদিও দেশটি ২০১৯ সালে পর্যটন শিল্প থেকে ৩৫ বিলিয়ন ডলার আয় করে এবং বিশ্বের শীর্ষ ১০টি পর্যটন শিল্পখাত থেকে আয়কারী দেশের একটি হিসেবে তুরস্ককে বিবেচনা করা হয়। তবে ২০২০ সালে সারা বিশ্ব ব্যাপী করোনা ভাইরাইসের ভয়ঙ্কর থাবা এবং বিশ্ব অর্থনীতির চরম মহামন্দার কবলে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়েছে তুরস্কের পর্যটন শিল্পখাত এবং জাতীয় রপ্তানি। তবে আশা করা যায় এই মহামারি কাটিয়ে উঠে তুরস্কের অর্থনীতি আবারো তার স্বাভাবিক গতি ফিরে পাবে ২০২১ সালের মধ্যেই।

 

সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com

Comments

  1. তথ্যবহুল আলোচনা বিশেষ করে তুরস্কের জন্য ভালো উপদেশ ও বটে। আমারও একই মতামত আরো অন্তত দশ বছর পর তুরস্ক বর্তমানে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করছে সেটা করলে ভালো হতো।

    ReplyDelete
  2. তথ্যবহুল আলোচনা বিশেষ করে তুরস্কের জন্য ভালো উপদেশ ও বটে। আমারও একই মতামত আরো অন্তত দশ বছর পর তুরস্ক বর্তমানে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করছে সেটা করলে ভালো হতো।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

এক লিজেন্ডারী যুদ্ধবিমান এফ-১৪ টমক্যাট ফাইটার জেটঃ

ভারত ও চীনের সীমান্ত উত্তেজনা...

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার দ্রুত বাস্তবায়ন আর কত দূরে ?