বিংশ শতাব্দীর আশির দশকের এক প্রভাব বিস্তারকারী অসম সভিয়েত-আফগান যুদ্ধ নিয়ে একটি কৌশলগত বিশ্লেষণঃ
বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে সংঘটিত অত্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী ও ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী একটি দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধ হচ্ছে আফগান সোভিয়েত অসম যুদ্ধ। যুদ্ধটি সরাসরি কোন সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘটিত না হলেও বাস্তবিক অর্থেই এটি ছিল অত্যন্ত প্রাণঘাতী এবং মানবিক বিপর্যয়কর একটি যুদ্ধ। আর আফগান সোভিয়েত যুদ্ধকে এ জন্য অত্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী যুদ্ধ বলা হয়, কারণ এ যুদ্ধের পরিসমাপ্তির মাধ্যমে সারা বিশ্বে চলমান চার দশক ব্যাপী অত্যন্ত ভীতিজনক কোল্ড ওয়ার বা স্নায়ু যুদ্ধের চীর অবসান ঘটে। তাছাড়া এই যুদ্ধে তৎকালীন সভিয়েত কমিউনিস্ট সরকার ও তার লাল ফৌজ কিন্তু মার্কিন মদদে গঠিত একটি স্বল্প প্রশিক্ষিত আফগান গেরিলা বাহিনীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিয় বরণ করে নেয়।
আসলে তৎকালীন সভিয়েত ইউনিয়ন সরকার তার সমর্থিত ও মদদপুষ্ট আফগানিস্তানের নাজিবুল্লাহ সরকারকে কৌশলগত কারণে সামরিক সহায়তা এবং সারা দেশব্যাপী চলমান গৃহযুদ্ধে মুজাহিদীন গেরিলা সঽগঠনের আক্রমন থেকে রক্ষা করার নামে কোন রকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৯ সালে হঠাৎ করেই সভিয়েত লাল ফৌজের হাজার হাজার সেনা, বিপুল পরিমাণ ট্যাংক ও আর্টিলারী এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্রসহ শতাধিক যুদ্ধ বিমান ও হেলিকপ্টার বহর নিয়ে সরাসরি আফগানিস্তানে প্রবেশ করে নয় বছর এক মাস ব্যাপী এক দীর্ঘ মেয়াদী, ব্যয়বহুল ও ভয়াবহ প্রাণঘাতি যুদ্ধে জরিয়ে পরে। প্রথম দিকে এ অসম যুদ্ধে সভিয়েত বাহিনী ব্যাপক সফলতা লাভ করলেও পরবর্তীতে মার্কিন হস্তক্ষেপ, আফগান মুজাহেদীন গেরিলাদের প্রশিক্ষণ এবং ব্যাপক আকারে অত্যাধুনিক ক্ষুদ্র অস্ত্র ও সামরিক সাজ সরঞ্জাম সরবরাহে আফগান যুদ্ধক্ষেত্র সভিয়েত সরকারের লাল ফৌজের জন্য এক রকম গলার কাটা হয়ে দেখা দেয়। তাছাড়া মাঝ পথে রণে ভঙ্গ দিয়ে সরে আসাটা তৎকালীন বিশ্বের প্রথম সারির সামরিক পরাশক্তি সভিয়েত কমিউনিস্ট সরকারের পক্ষে একটি বড় ধরণের পেস্টিজ ইস্যু হয়ে দেখা দেয়। তাছাড়া দীর্ঘ নয় বছর ব্যাপী প্রাণঘাতী এ যুদ্ধ পরিচালনায় প্রায় ৫০.০০ বিলিয়ন ডলারের অধিক বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে সভিয়েত সরকার অর্থনৈতিকভাবে এক রকম দেউলিয়া হয়ে যেতে থাকে।
এখানে প্রকাশ যোগ্য যে, সাধারণ দৃষ্টিতে আফগান যুদ্ধে রাশিয়া বা তৎকালীন কমিউনিস্ট সভিয়েত ইউনিয়ন তাদের সমর্থিত আফগান নাজিবুল্লাহ সরকারকে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্দশ্যে সামরিক বহর প্রেরণ করলেও এক্ষেত্রে সভিয়েত ইউনিয়নের কিন্তু মূল উদ্দেশ্য বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছিলো অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। সভিয়েত ইউনিয়ন কার্যত আাফগানিস্তান দখলের মাধ্যমে পরবর্তীতে সুযোগ মতো প্রভাব বিস্তার করে বা সামরিক উপায়ে পাকিস্তানে বা ইরানের সমুদ্র উপকূলবর্তী আংশিক অঞ্চল হস্তগত করার মাধম্যে সরাসরি আরব সাগর এবং ভারত মহাসাগরের লাল বাহিনীর প্রবেশের পথ উম্মুক্ত করার ছক অনেক আগেই তৈরি করে রেখেছিল। তাছাড়া এ মহা পরিকল্পনায় আওতায় সভিয়েত বাহিনী ভবিষ্যতে সুযোগ মতো আরব সাগরে মধ্যপ্রাচ্যের বৈশ্বিক বাজারে তেল সরবরাহের পথ নিয়ন্ত্রণ বা নিজ দখলে আনার মাধ্যমে কৌশলগত ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার জোটকে চাপে রাখা বা প্রতিহত করাই ছিল এর মুখ্য উদ্দেশ্য। আবার ভারত মহাসাগরে সরাসরি প্রবেশ এবং এতদ অঞ্চলে সামরিক প্রভাব বিস্তার ও নিজস্ব সামরিক আবস্থান সুদৃঢ় করতে চেয়েছিলো তৎকালীন সভিয়েত রেড আর্মী। যদিও আমার এহেন যুক্তিটি বাস্তব সম্মত নাও হতে পারে। তবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও প্রাণঘাতী এই আফগান যুদ্ধে তৎকালীন কমিউনিস্ট সভিয়েত ইউনিয়ন সরকারের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন দীর্ঘ ৯ বছর এক মাসব্যাপী ভয়াবহ এই আফগান যুদ্ধে সভিয়েত ইউনিয়ন মারাত্মকভাবে অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং যুদ্ধে সভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো এবং সক্ষমতা এক রকম ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌছে যায়। তবে যে যাই বলুক না কেন, প্রায় চার দশক ব্যাপী সভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের বুকে নিজেকে প্রথম স্থানীয় সামরিক পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেও কিন্তু কোন দিনই নিজেকে উচ্চ মাত্রায় অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। তাছাড়া সভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বমঞ্চে যে সমস্ত দেশের সাথে কৌশলগত এবং সামরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল সেখানে চীন ব্যাতিত অধিকাংশ দেশই ছিল অর্থনৈতিকভাবে শক্তিহীন এবং কম গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে অত্যন্ত কৌশলী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই অধিকতর ধনী এবং সম্পদে পরিপূর্ণ দেশগুলো এবং তাঁদের সরকারকে নিজ নিয়ন্ত্রণে রেখে কৌশলগতভাবে প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি এমনকি এখনো পর্যন্ত চরম মাত্রায় অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে।
আসলে আফগান যুদ্ধে সভিয়েত বাহিনীর সামরিক ক্ষতি এবং ধ্বংসযজ্ঞের প্রকৃত কোন তথ্য উপাত্ত পাওয়া সম্ভব না হলেও মনে করা হয় এ যুদ্ধে সোভিয়েত বাহিনীর প্রায় তিন শতাধিক জেট ফাইটার বা বোম্বার এবং পাশাপাশি চার শতাধিক কমব্যাট ও সামরিক পরিবহণ হেলিকপ্টার সরাসরি ধ্বংস কিম্বা মারাত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদিও তৎকালীন সময়ে সভিয়েত সরকার আফগান যুদ্ধে তাঁদের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি বিপর্যয় বিশ্ববাসীর চোখে আড়াল করতে থাকে এবং বর্তমানে ইউকী পিডিয়া বা অন্যান্য সামরিক ওয়েবসাইটে যে তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছে তা কিন্তু যথেষ্ঠ প্রশ্নবিদ্ধ বা অনেকটা অনুমান নির্ভর। বিষয়টি আনুমানিক হলেও মনে করা হয় দীর্ঘ মেয়াদী এ যুদ্ধে সভিয়েত সামরিক বাহিনীর পক্ষে তেরো শতাধিক ট্যাংক, হাজার খানেক আর্টিলারী সিস্টেম পাশাপাশি হাজারের উপর সামরিক যান ও সাজ সরঞ্জাম একেবারে ধ্বংস অথবা মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখানে প্রকাশ যোগ্য যে, আশির দশকে সভিয়েত বিমান বাহিনীতে তৎকালীন সময়ের স্টেট আর্ট খ্যাত অত্যাধুনিক মিগ-২৯ ও এসইউ-২৭ এর মতো সুপার ম্যানুভার ফাইটার জেট থাকলেও, এগুলো যে কোন কারণেই হোক যুদ্ধে গেম চেঞ্জার হিসেবে একেবারেই কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে বা তার কথিত উচ্চ মাত্রায় প্রযুক্তিগত সক্ষমতা প্রদর্শনে শোচনীয়ভাবে ব্যার্থ হয়েছিল।
যদিও যুদ্ধের একেবারে শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সহায়তায় আফগান মুজাহিদীন গেরিলাদের সামরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বিলিয়ন ডলারের বিপুল পরিমান হালকা যুদ্ধাস্ত্র ও সাজ সরঞ্জাম ধারাবাহিকভাবে সরবরাহ করতে থাকে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজ ইচ্ছামতো অস্ত্র ও সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখলেও মনে করা হয় আফগান যুদ্ধের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যয়ভার কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রবাশালী দেশ সৌদি আরব এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা বহন করতে থাকে। যার ফলে আফগান যুদ্ধে মার্কিন প্রশাসন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ পেয়ে যয়। এদিকে আফগান যুদ্ধে মার্কিন প্রশাসন অস্ত্র সরবরাহের পাশাপাশি তাঁদের উচ্চ মাত্রার অত্যাধুনিক শতাধিক যুদ্ধাস্ত্র এবং সামরিক সাজ সরঞ্জাম প্রতি নিয়ত পরীক্ষা এবং গবেষণা করতে কোন রকম ত্রুটি রাখেনি। আবার মার্কিন সামরিক বাহিনীর সরবরাহকৃত হালকা বহনযোগ্য হিউম্যান প্রট্রেবল স্ট্রিংগার ক্ষেপনাস্ত্রের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও ব্যাপক ব্যবহার সভিয়েত বিমান বাহিনীতে এক ভীতিজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে এবং স্ট্রিংগার মিসাইল দ্বারা আফগান মুজাহিদীন গেরিলারা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অসংখ্য সভিয়েত বিমান এবং হেলিকপ্টার সফলতার সাথে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে যুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে সভিয়েত সামরিক বাহিনীর হাজার হাজার সেনা এবং পাইলটের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন সভিয়েত কোয়ালিশন বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় এক রকম সুনিশ্চিত করে ফেলে।
নয় বছরব্যাপী চলা আফগান যুদ্ধে সভিয়েত সামরিক বাহিনীর প্রায় বিশ হাজার সেনা ও বৈমানিক নিহত হয় এবং পাশাপাশি প্রায় ত্রিশ হাজারের অধিক সেনা সদস্য মারাত্মকভাবে আহত বা চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে আফগান পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি ছিল অত্যন্ত ভয়ানক পর্যায়ের। এ যুদ্ধে সরাসরি এক লক্ষের অধিক আফগান মুজাহেদীন বা গেরিলা সদস্য মৃত্যুবরণ করে। আবার দেশটির আনুমানিক ১৩ লক্ষ সাধারণ ও নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। অথচ এই প্রাণহানির একটি বড় অংশ ছিল নারী ও শিশু এবং যাদের সাথে যুদ্ধের আদৌ কোন সম্পর্ক ছিল কিনা সন্দেহ।
দীর্ঘ মেয়াদী এবং অত্যন্ত ভয়াবহ মাত্রায় প্রাণঘাতী এই যুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে ১৫ই ফেব্রুয়ারী ১৯৮৯ সালে তৎকালীন কমিউনিস্ট সভিয়েত ইউনিয়ন সরকার আফগান যুদ্ধের চুড়ান্ত সমাপ্তি ঘোষণা করে আফগানিস্তান থেকে তাঁদের সকল সৈন্য ও সামরিক সাজ সরঞ্জাম সম্পূর্ণ ভাবে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। আর এর মাধ্যমে পতন হয় তৎকালীন সভিয়েত সমর্থীত আফগান নাজিবুল্লাহ সরকারের। এ যুদ্ধে জড়িয়ে সারা সভিয়েত ইউনিয়ন ব্যাপী এক মহা অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পতিত হওয়ার পাশাপাশি সারা দেশব্যাপী প্রশাসনিক পরিকাঠামো ও জাতীয় ঐক্য একেবারে ভেঙ্গে পড়তে থাকে। যার চূড়ান্ত ফলস্রুতিতে ২৬শে ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে গোটা সভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে সম্পূর্ণ নতুন ১৫টি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বের বুকে। এর সাথে চীর অবসান হয় এক ভীতিজনক ও দীর্ঘ মেয়াদী স্নায়ু যুদ্ধ (Cold war) যুগের।
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক, ৮২ নং ছোট চৌগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com
Comments
Post a Comment