পবিত্র আল কুরআনে বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষার গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তাঃ


পবিত্র আল কুরআনে বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষার গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তাঃ

লেককঃ সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman)- ০১৭১৪৬৬০০৫০


মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তালা মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আর যুগে যুগে মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য নবী রাসুলদের উপর প্রেরণ করেন মহান আসমানি কিতাব। আর সর্বশেষ বিজ্ঞানময় এবং মানবতার মুক্তি স্বরুপ পবিত্র আল কুরআন মানব জাতিকে দান করেছেন মহান আল্লাহ তালা। আল্লাহ তা‘আলা তার মনোনিত জিবরাঈল (আঃ) এর মাধ্যমে সুদীর্ঘ ২৩ বছরে মানব জাতিকে অন্ধকারচ্ছন্নতা এবং কুসংস্কার থেকে মুক্তিদানে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর যে পবিত্র আসমানী কিতাব অবতীর্ণ করেছেন তার নাম আল কুরআন। তাই প্রকৃত ইসলামের পথে চলতে হলে আমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ সক্ষমতা অনুযায়ী পবিত্র আল কুরআন পড়তে ও জানতে হবে। আমরা যদি নিজেকে প্রকৃত মুসলমান হিসাবে দাবী করতে চাই এবং মহানবী (সাঃ) এর দেখানো আদর্শকে অনুসরণ করতে চাই, তাহলে অবশ্যই সর্ব প্রথম কুরআন চর্চা এবং শিক্ষা অর্জন করতে হবে। কুরআন শিক্ষা করা এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির জন্য কুরআন শিক্ষা করা ফরয করে দিয়েছেন। পবিত্র আল কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ ٱقۡرَأۡ بِٱسۡمِ رَبِّكَ ٱلَّذِي خَلَقَ ١ [العلق: ١]
অর্থ: ‘পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’ [সূরা আলাক- ১]।


কার্যত পবিত্র আল কোরআন মানবতা এবং সহনশীলতা শিক্ষা দানের পাশাপাশি আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে অনুপ্রাণিত করে এবং সঠিক পথে নিজেকে পরিচালনায় ইতিবাচক দিক নির্দেশনা প্রদান করে। যাতে কুরআনের গভীর মর্ম ও শিক্ষা অর্জন করে আমরা ইসলাম ও বিজ্ঞান সম্মত আধুনিক জীবন যাপনে অভন্ত্য হই এবং পাশাপাশি ইহুদি ও নাসারাদের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং প্রযুক্তিগতভাবে প্রতিহত করার যথেষ্ঠ যোগ্যতা অর্জন করতে পারি। মধ্যযুগে মুসলিম বিশ্বে জ্ঞান বিজ্ঞনে উৎকর্ষতা এবং সাফল্য লাভে পবিত্র আল কুরআনের মর্মবাণী এবং গবেষণা এক গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। তৎকালীন সময়ে ইসলাম এবং পবিত্র কুরআন এর শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলিম বিশ্ব বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে সারা বিশ্বজুড়ে শিল্প এবং প্রযুক্তি বিল্পব সংঘটিত হয়। যার চুড়ান্ত শিল্পায়ন এবং প্রযুক্তিগত সুফল আমরা আজ উপভোগ করছি।

যদিও জ্ঞানের আলো নিভে মুসলিম বিশ্ব আজ দিশাহার এবং অত্যন্ত উচ্চ মাত্রায় প্রাচ্য এবং প্রশ্চাত্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। অথচ আধুনিক সভ্যতার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নেপথ্য থেকে যদি মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদানকে সরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে এই বর্তমান যুগের আবিষ্কার ও আধুনিকায়ন ধসে পড়বে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসে মুসলমানদের অবদান অপরিসীম। ঐতিহাসিক হিট্টি বলেছেন, ‘অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগ সময় থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত মুসলিমরা সমগ্র বিশ্বের বুদ্ধি এবং সভ্যতার বাতিঘর ছিল’। সমকালীন সময়ে মুসলিম বিশ্বের ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরের সাথে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা এবং গবেষণায় প্রবল প্রতিযোগিতা করত। সেখান থেকে সৃষ্টি হয়েছিল আল কেমি, ইবনে সিনা, আল-খোয়ারিজম, ইবন তুলুন, ইবনে আল হাইছাম এর মতো অসংখ্য খ্যাতমান দার্শনিক, সাধক, বিজ্ঞানী, গণিতবিদ , চিকিৎসক এবং পর্যটক। তাই কুরান মাজীদ যে সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম উৎস এবং পবিত্র কুরআন জ্ঞান বিজ্ঞান নিয়ে যে নির্দেশনা দিয়েছে তা নির্ভুল ও বাস্তব সম্মতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। কুরআনে আল্লাহ পাক বলেন,
﴿ يسٓ ١ وَٱلۡقُرۡءَانِ ٱلۡحَكِيمِ ٢ [يس: ١، ٢]
অর্থ: ‘ইয়া-সীন। বিজ্ঞানময় কুরআনের শপথ’ [সূরা ইয়াছিন:১-২]।

আবার মহাবিশ্বের সাম্প্রসারণ সম্পর্কে পবিত্র কোরানে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, "আমি নিজ হাত দ্বারা আকাশ মণ্ডলী সৃষ্টি করেছি এবং আমিই এর সম্প্রসারণকারী।" (জারিয়াত, আয়াত-৪৭)। এখানে প্রকাশ যোগ্য যে, বর্তমান সময়ে খ্যাতিমান পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস তার বিখ্যাত 'ব্রিফ হিস্টোরি অফ টাইমস' (A Brief History of Times) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, "মহাবিশ্ব সর্বদাই সম্প্রসারিত হচ্ছে।" সুতারাং এ থেকে প্রমাণ হয় বিজ্ঞান এবং কোর আম একে অপরের বিরুদ্ধে নয়, বরং একে অপরের নিয়ামক বা সহযোগী

তাই বাস্তব জীবনে শুধুমাত্র কিছু আয়াত বা সুরা বার বার পড়ে বা মুখস্ত করে মাথায় আলো নিয়ে দিন কাটানোর জন্য মহান আল্লাহ তালা জ্ঞানের ভান্ডার স্বরুপ পবিত্র আল কোরআন মানব জাতির উপর নাযিল করেন নি। আবর কোন দোয়া পাঠের মাধম্যে কোটি কোটি নেকি বা সাওয়াব পাওয়া যাবে এমন আশা বা ধারণা পোষণ করাও কিন্তু অযৌক্তিক। অন্ধকারে নিমজ্জিত মুসলিম জাতিকে সত্যিকার আলোর দিকে নিয়ে আসার জন্য আল-কুরআন হলো এক আলো বা নুর। আর এই কুরআনের আলো হৃদয়ে ধারণ করে একতাবদ্ধভাবে স্বল্প পরিসরে হলেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে মুসলিম বিশ্বের কল্যান ও উন্নতি সাধণে এবং পাশাপাশি ইসলামের শ্ত্রুদের কার্যকরভাবে প্রতিহত করার বিকল্প কোন রাস্তা আছে বলে মনে হয় না। পবিত্র আল কোর আনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
﴿ قَدۡ جَآءَكُم مِّنَ ٱللَّهِ نُورٞ وَكِتَٰبٞ مُّبِينٞ ١٥ يَهۡدِي بِهِ ٱللَّهُ مَنِ ٱتَّبَعَ رِضۡوَٰنَهُۥ سُبُلَ ٱلسَّلَٰمِ وَيُخۡرِجُهُم مِّنَ ٱلظُّلُمَٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ بِإِذۡنِهِۦ وَيَهۡدِيهِمۡ إِلَىٰ صِرَٰطٖ مُّسۡتَقِيمٖ ١٦ [المائدة: ١٥، ١٦]
অর্থ: ‘অবশ্যই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে আলো ও সুস্পষ্ট গ্রন্থ এসেছে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদেরকে শান্তির পথ দেখান, যারা তাঁর সন্তুষ্টির অনুসরণ করে এবং তাঁর অনুমতিতে তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করেন। আর তাদেরকে সরল পথের দিকে হিদায়াত দেন’ [সূরা মায়িদাহ-১৫,১৬]।


আধুনিক বিজ্ঞান বলছে পৃথিবীর বয়স আনুমানিক ৪.৬ বিলিয়ন বছর এবং এখানে প্রাণের বিকাশ ঘটেছে পানি বা সমুদ্র থেকে অথচ পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক ১৪০০ বছর আগেই বলেছেন, "অবিশ্বাসীরা কি দেখে না যে, আকাশ আর যমীন এক সঙ্গে সংযুক্ত ছিল, অতঃপর আমি উভয়কে আলাদা করে দিলাম, আর প্রাণসম্পন্ন সব কিছু পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। তবুও কি তারা ঈমান আনবে না?" আর পৃথিবীতে আমি স্থাপন করেছি সুদৃঢ় পর্বত যাতে পৃথিবী তাদেরকে নিয়ে নড়াচড়া না করে। আর তাতে সৃষ্টি করেছি প্রশস্ত পথ যাতে তারা পথ পেতে পারে।" (সুরা আম্বিয়া, আয়াত-৩০-৩১)


আসলে পবিত্র আল কোরআন অধ্যায়ন এবং গবেষণার মাধম্যে এ থেকে অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম উম্মাহ এর কল্যানে এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নে স্বল্প পরিসরে হলেও কিছু চেষ্টা করার মধ্যেই প্রকৃত সার্থকতা লুকিয়ে রয়েছে। আর মহান আল্লাহ তালার নৈকট্য লাভের অন্যতম উপায় হতে পারে পবিত্র কোরআনের অর্জিত জ্ঞানকে বাস্তব জীবনে কাজে লাগানো এবং মহান আল্লাহ তালা এবং তার প্রেরিত রাসুলের দেখানো আদর্শকে অনুসরণের মাধম্যে আমরা পেতে পারি প্রকৃত মুক্তি। তাই আসুন আমরা সবাই অহেতুক অন্য ধর্মের দোষ ত্রুটি অনুসন্ধান না করে পবিত্র আল কুরআনের মর্মবাণী অনুধাবণ বা শিক্ষা অর্জনের মাধম্যে এবং পাশাপাশি নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করে নিজেকে জান্নাতের প্রকৃত যোগ্য অধিকারী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলি। আবার কঠোর পরিশ্রম এবং মেধা দ্বারা আমাদের জীবনে সর্বোচ্চ সাফল্য এবং অর্থ আসলেও কিম্বা অন্যান্য জাগতিক কারণে আমাদের জীবনে তৃপ্তি আসলেও প্রকৃত তৃপ্তি বা আত্মার শুদ্ধি এবং শান্তি কেবল পবিত্র আল কুরআন চর্চা এবং শিক্ষার মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব। তাই আল্লাহ পাক কুরআনে আবারো বলেছেন,
﴿ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَتَطۡمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكۡرِ ٱللَّهِۗ أَلَا بِذِكۡرِ ٱللَّهِ تَطۡمَئِنُّ ٱلۡقُلُوبُ ٢٨ [الرعد: ٢٨]
অর্থ : ‘যারা ঈমান আনে, বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে। জেনে রাখ, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়’ [সূরা আর-রা‘দ:২৮]।


আমি স্বল্প পরিসরে এ প্রবন্ধে পবিত্র আল কোরআনের কিছু আয়াত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করলাম এখানে আপনারা নিশ্চয় এক বাক্যেই স্বীকার করবেন সেই মধ্যযুগে বা ১৪০০ বছর আগে কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে বৈজ্ঞানিক এবং বিশ্লেষণ ভিত্তিক জ্ঞান থাকা বা জানা সম্ভব নয় তার মানে আল কোরআন মহান আল্লাহ তালার প্রেরিত সর্বশেষ পবিত্র ধর্মগ্রন্থ তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যদি তারপরও কেউ অবিশ্বাস বা মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করেন তাকে আমার কিছু বলার নেই পরশেষে পবিত্র আল কোরআনে আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেন,
صُمٌّۢ بُكْمٌ عُمْىٌ فَهُمْ لَا يَرْجِعُونَ
“তারা বধির, বোবা ও অন্ধ সুতারাং তারা ফিরে আসবে না“ (সুরা বাকারাহ, আয়াত-১৮)

সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, ছোট চৌগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com


Comments

Popular posts from this blog

এক লিজেন্ডারী যুদ্ধবিমান এফ-১৪ টমক্যাট ফাইটার জেটঃ

ভারত ও চীনের সীমান্ত উত্তেজনা...

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার দ্রুত বাস্তবায়ন আর কত দূরে ?