বিশ্বে পরমাণু অস্ত্রের প্রসার এবং আমাদের ভবিষ্যতঃ

বিশ্বে পরমাণু অস্ত্রের প্রসার এবং আমাদের ভবিষ্যতঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে জাপানের পরাজয় সুনিশ্চিত জেনেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে (লিটল বয় ও ফ্যাটম্যান নামক স্বল্প ২০-২৫ কিলোটন সক্ষমতার) ভয়াবহ পারমানবিক হামলার মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে এক নতুন ভয়ঙ্কর এবং প্রাণঘাতী অস্ত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। আর এই অমানবিক নিউক হামলার মাধ্যমে তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন তার নিজস্ব সর্বোচ্চ সামরিক সক্ষমতা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে এবং নিজেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত করে বিশ্বের অন্যতম প্রধান সামরিক সুপার পাওয়ার রাষ্ট্র হিসেবে। যদিও অবশ্য এই পারমাণবিক হামলার পর বিশ্বে সাময়িকভাবে স্থিতিবস্থা ফিরে আসে এবং ফল স্বরুপ সভিয়েত ইউনিয়ন জাপান দখলের প্রচেষ্টা থেকে পিছু হটে ও পশ্চিম ইউরোপ জয়ের রথযাত্রা থামাতে এক রকম বাদ্ধ হয়। এছাড়া ইউরোপের অন্যান্য ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন পারমানবিক প্রযুক্তি অর্জনের সক্ষমতাকে মেনে নিয়ে সভিয়েত ইউনিয়নসহ পরবর্তীতে নিজেরাও পারমানবিক প্রযুক্তি অর্জনে ব্যাপক আকারে বিনিয়োগ ও গবেষণা শুরু করে। যার ফলস্রুতিতে বিশ্ব আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সভিয়েত শিবিরে বিভক্ত হয়ে প্রবেশ করে নতুন এক দীর্ঘস্থায়ী স্নায়ুযুদ্ধ (Cold war) যুগে এবং এক দশকের মধ্যে শুরু হয় ভয়াবহ নিউক্লিয়ার ও থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্র প্রতিযোগিতা।


বর্তমানে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াসহ বিশ্বের দশটি দেশের অস্ত্র ভান্ডারে মজুদ রয়েছে আনুমানিক ১৬,০০০ এর কাছাকাছি নিউক্লিয়ার ও থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্র ও ওয়ারহেড। যা সমুদ্র ভিত্তিক সাবমেরিন ও সাইলো বেসড এন্ড মোবাইল লাউঞ্চ লং রেঞ্জের ব্যালেস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম), মিডিয়াম ও সর্ট রেঞ্জ ট্যাকটিক্যল মিসাইল এবং সর্বোপরি বোম্বার ও সুপার বোম্বার ভিত্তিক বোম্ব ও ওয়ারহেড এর উপযোগী করে গোপনে সংরক্ষণ করা হয়েছে। আবার বিশ্বের মোট পারমাণবিক অস্ত্রের সর্বোচ্চ ৮৮.৯০% মজুদ রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার হাতে। তাছাড়া, কৌশলগতভাবে ভবিষ্যতে যে কোন ভয়াবহ যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে রাশিয়া ও মার্কিন সামরিক বাহিনী অত্যন্ত গোপনে আনুমানিক ২০০০ এর কাছাকাছি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড স্ট্যাটিজিক্যাল মিসাইলে সংযুক্ত করে সার্বক্ষণিকভাবে একে অপরের বিরুদ্ধে হামলার উদ্দেশ্যে গোপন কোন ঘাঁটিতে এবং সাবমেরিনে সক্রিয়ভাবে মোতায়েন করে রেখেছে। যা ভবিষ্যত মানব সভ্যতার জন্য এক মারাত্বক হুমকী হিসেবে থেকে যাচ্ছে। এ মুহুর্তে বিশ্বের পারমাণবিক ক্ষমতাধর দেশগুলোর কাছে যে পরিমান নিউক অস্ত্র মজুদ রয়েছে তা দিয়ে নিশ্চিতভাবে আমাদের এই সুন্দর মেদিনীকে শতাধিকবার ধ্বংস করা যাবে তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না।


আন্তর্জাতিক পর্যায়ের স্টকহোম ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনিস্টিউট, বিজনেস ইনসাইডার, জেনস রিপোর্ট, গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারসহ অন্যান্য সামরিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও থিংক ট্রাঙ্ক বিশ্বের ১০টি দেশের কাছে কি পরিমাণ ও সক্ষমতার নিউক্লি়য়ার ও থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্র ও ওয়ারহেড মজুদের বিষয়ে যে তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান প্রদর্শন করে তা কিন্তু সম্পূর্ণ গবেষণামুলক বিশ্লেষণ ও অনুমানের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা। যার কোন বাস্তব ভিত্তি বা গ্রহনযোগ্য কোন প্রমান নেই। আবার বিশ্বের পারমাণবিক অস্ত্র সমৃদ্ধ দেশগুলো কিন্তু কৌশলগত কারণে তাদের নিউক সক্ষমতা নিয়ে কোন তথ্য উপাত্ত প্রকাশ করে না এবং বৈশ্বিক মিডিয়ায় আমরা পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে যে ডাটা পাই তা নিশ্চিতভাবেই অনুমান নির্ভর এবং তা বাস্তবে অনেকের ক্ষেত্রে বড় ধরণের কম বেশি হতে পারে। এমনকি সুপার পাওয়ার দেশগুলো নিজের প্রভাব ও কৌশল খাটিয়ে চাতুরতার সাথে নিজেদের নিউক সক্ষমতা অতিরঞ্জিত অকারে প্রকাশে কাজ যে করছে না তাও নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না।


এ মুহুর্তে বৈশ্বিক পারমাণবিক অস্ত্র সক্ষমতার বিচারে সবচেয়ে এগিয়ে আছে রাশিয়া। তাদের গোপন অস্ত্র ভান্ডারে আনুমানিক ৭৮৬০টি নিউক্লিয়ার ও ভয়ঙ্কর থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্র ও ওয়ারহেড মজুদ রয়েছে এবং রাশিয়ান স্ট্যাটিজিক মিসাইল ফোর্সেস ইউনিটের হাতে সর্বোচ্চ ১৫০০০ কিলোমিটার পাল্লার আরএস-৩৬/২৮ (আইসিবিএম) সহ প্রায় ১৬৮০টি মিডিয়াম, সর্ট এন্ড লং রেঞ্জের স্ট্যাটিজিক মিসাইল মজুদ রয়েছে। সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে সর্বোচ্চ ৭৩১০টি নিউক্লিয়ার ও থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়ারহেডসহ ৯০০টি এর কাছাকাছি স্ট্যাটিজিক্যাল মিসাইল এবং লং রেঞ্জ সুপার বোম্বার বি-৫২ ও বি-২ স্পিরিট ডেলিভারি সিস্টেম এর উপযোগী করে বিশাল আকারের নিউক বোম্ব এন্ড ডিভাইস ডিজাইন করে রেখেছে। তাছাড়া, ফ্রান্সে কাছে ৩৫০টি, যুক্তরাজ্যের অস্ত্র ভান্ডারে সর্বোচ্চ ৩০০টি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড থাকতে পারে। তবে, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের নিউক্লিয়ার অস্ত্র সম্পূর্ণভাবে পারমাণবিক সাবমেরিন চালিত ব্যালেস্টিক মিসাইল সিস্টেম ভিত্তিক গড়ে তোলা হয়েছে। তবে প্রকাশ থাকে যে, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের কমপক্ষে একটি করে পারমাণবিক সাবমেরিন সম্পূর্ণ নিউক ব্যালেস্টিক মিসাইল লোডেড অবস্থায় সার্বক্ষণিক সমুদ্রে মোতায়েন রাখা হয়। এদিকে চীনের অস্ত্র ভান্ডারে ২৫০টি, ইসরাইলের ১০০টি, পাকিস্তানের ১৪০টি, ভারতের ১৩০টি এবং উত্তর কোরিয়ার কিম বাহিনীর হাতে আনুমানিক ২০-30টি নিউক্লিয়ার ও থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্র ও ওয়ারহেড মজুদ থাকতে পারে। আর উত্তর কোরিয়ার হাতে স্বল্প পরিমাণ ও সক্ষমতার কিছু সংখ্যক নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ও লং রেঞ্জের ব্যালেস্টিক মিসাইল থাকায়, আমেরিকার ট্রাম্প বাহিনী এখনো পর্যন্ত সরাসরি উত্তর কোরিয়ার উপর আক্রমনের সাহস দেখাতে পারছেনা। যদিও অবশ্য আমেরিকা তার এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের জোটভুক্ত দেশ বিশেষ করে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া অস্ট্রেলিয়াসহ বেশকিছু দেশকে সাথে নিয়ে অত্যন্ত ব্যয়বহুল সামরিক মহড়া, পেশীশক্তি প্রদর্শন ও সুপার বোম্বার উড্ডয়ন অব্যাহত রেখেছে।


যদিও এ পরিসংখ্যানটি নিরপেক্ষ কোন মাধ্যমে প্রমান করার কোন সুযোগ নেই। তবে বাস্তবে ভারত ও চীনের কাছে আরো বেশি সংখ্যক বিশেষ করে পাকিস্তান, ভারত ও চীনের স্ট্যাটিজিক সামরিক বাহিনীর হাতে কমপক্ষে দ্বিগুন বা তার বেশি সংখ্যক নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ও ডিভাইস থাকার সমুহ সম্ভবনা থেকে যাচ্ছে। আবার এদিকে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সামরিক পরাশক্তি চীন নিশ্চিতভাবেই অত্যন্ত গোপনেই নিউক্লিয়ার ও থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্রের বিশাল মজুত গড়ে তুলছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী চীনের অস্ত্র ভান্ডারে ২৫০টি এর কাছাকাছি পারমাণবিক অস্ত্র থাকার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। কিন্তু ২০১৪ সালের দিকে তাইওয়ান ভিত্তিক গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চীন ভু-গর্ভস্থ একাধিক গোপন ঘাঁটি ও গবেষণাগারে নতুন প্রজন্মের ব্যালেস্টিক মিসাইল বেসড হাজারের অধিক নিউক্লিয়ার ও থার্মোনিউক্লিয়ার ওয়ারহেড উন্নয়নে এবং সর্বোপরি দীর্ঘ ও মধ্যম পাল্লার স্ট্র্যাটিজিক্যাল ক্ষেপনাস্ত্রের বিশাল মজুত গড়ে তুলছে এবং বিশ্ববাসীর নজর এড়িয়ে এ খাত উন্নয়নে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যাচ্ছে। আরেক হিসেব তথ্যমতে চীনের স্ট্যাটিজিক মিসাইল ফোর্সের নিয়ন্ত্রণে এ মুহুর্তে আনুমানিক ৬৮০টি বিভিন্ন পাল্লার কৌশলগত ক্ষেপনাস্ত্র মজুত রয়েছে। সে হিসেবে চীনের প্রদত্ত নিউক সংখ্যা ও স্ট্যাটিজিক্যাল মিসাইলের পরিমাণে গড়মিল বেশ লক্ষ্যনীয় এবং এক রকম হাস্যকর বটে। আবার, খুব সম্ভবত ভারতের কাছে আনুমানিক ২০০টি এবং পাকিস্তানের কাছে ১৫০টি বিভিন্ন পাল্লার স্ট্যাটিজিক্যাল ও ট্যাকটিক্যাল মিসাইলের বিশাল মজুত রয়েছে এবং ভবিষ্যতে যে কোন ধরণের যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে একে অপরের বিরুদ্ধে পরমানু অস্ত্র প্রয়োগে হুমকি পাল্টা হুমকি অব্যাহত রেখেছে। যা আমাদের দক্ষিণ এশিয়া এমনকি সর্বোপরি বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিবস্থার জন্য ভয়ানক হুমকী হিসেবে থেকে যাচ্ছে।


তবে পরিশেষে বলা যায়, পরমাণু অস্ত্র শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার হাতে না থেকে বিশ্বব্যাপী একাধিক দেশের হাতে স্বল্প পরিমানে হলেও ছড়িয়ে থাকার জন্য বিশ্বে এক রকম ভারসাম্যপূর্ণ সামরিক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী চরম সংঘাত ও যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করলেও, শুধুমাত্র একাধিক দেশের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র ও সক্ষমতা থাকার জন্য বিশ্বে এখনো পর্যম্ত সাত দশকের মধ্যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো অতি ভয়ানক যুদ্ধ শুরু হচ্ছে না বা নিকট ভবিষ্যতেও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগার কোন সমুহ সম্ভাবনা আছে বলে আমার মনে হয় না। যা হচ্ছে শুধু প্রভাব বিস্তার, সামরিক ও পেশীশক্তি প্রদর্শন এবং কৌশলে অস্ত্র বানিজ্য। যদি এখানে একমাত্র মার্কিনী বা রাশিয়ানদের হাতেই নিউক্লিয়ার অস্ত্র থাকত, তাহলে হয়ত নিশ্চিতভাবেই বিশ্বের আরো বেশকিছু শহর বা দেশকে হিরোশিমা বা নাগাসাকির মতো অতি ভয়ানক ও প্রাণঘাতী ধ্বংসাত্বক অবস্থা বরণ করতে হতো বলে আমি মনে করি। তবে আশার বিষয় এমন পরিস্থিতি হওয়ার সুযোগ এক রকম নেই বললেই চলে। তাই পারমাণবিক অস্ত্রকে মানব জাতির অভিশাপ মনে করা হলেও বাস্তবে কিন্তু এটি বিশ্বকে পরোক্ষভাবে ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে যাচ্ছে, যা বলার অবকাশ রাখে না।

সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, জয়কুড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com

Comments

Popular posts from this blog

এক লিজেন্ডারী যুদ্ধবিমান এফ-১৪ টমক্যাট ফাইটার জেটঃ

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার দ্রুত বাস্তবায়ন আর কত দূরে ?

এবার আমেরিকার এফ-১৬ যুদ্ধবিমান পেতে যাচ্ছে তুরস্কঃ