ভারত ও চীনের সীমান্ত উত্তেজনা...
ভারত ও চীনের মধ্যে সিকিম অঞ্চলে
সীমান্ত অতিক্রমের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে দেশ দুটি মাঝে চরম বিরোধ ও সামরিক
উত্তেজনা বিরাজ করছে। বলে যেতে পারে ১৯৬২ এর ভয়াবহ যুদ্ধের পর উভয় পক্ষের মধ্যে
কোন রকম সরাসরি সীমান্ত সংঘর্ষ না হলেও ভারত ও চীন একে অপরের বিরুদ্ধে কৌশলগতভাবে
প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং পাশ্ববর্তী দেশগুলোতে নিজের প্রভাব
বিস্তারে ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তাছাড়া বর্তমানে দেশ দুটি সীমান্ত উত্তেজনাকে
কেন্দ্র করে চরম পর্যায়ে একে অপরকে দোষারোপ করার পাশাপাশি অদূর ভবিষ্যতে
যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় সীমান্তে এক রকম নিরবেই ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতি ও
সমাবেশ করতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে ভারত ও চীনের সীমান্ত
উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে যে যাই বলুক বা মনে করুক আপাতত ভারত ও চীনের মধ্যে স্বল্প
পরিসরে বা ব্যাপক আকারের সরাসরি সীমান্ত
সংঘর্ষ এমনকি পূণাঙ্গ যুদ্ধের কোন সম্ভবনা আছে বলে আমার মনে হয় না। তাছাড়া উদীয়মান
এশিয়ার দুই বৃহৎ অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি চীন ও ভারত এ মুহুর্তে বাস্তবিক
অর্থে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি স্বীকার করে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়ানোর মতো
কোন শক্ত অবস্থানে আছে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। তাছাড়া ভবিষ্যতে
যে কোন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ভারত বা চীনের পক্ষে অপ্রচলিত পারমানবিক অস্ত্র
প্রয়োগের মতো ভয়াবহ ঝুঁকি নেয়া খুবই কঠিন হয়ে উঠতে পারে বা এক কথায় অসম্ভব। যদিও এ
মুহুর্তে চীনের অস্ত্র ভান্ডারে ২৫০টি এবং ভারতের অস্ত্র ভান্ডারে ১২০টি বা তার
বেশি পারমানবিক অস্ত্র ও ওয়ারহেড মজুত থাকতে পারে।
আপাতত দৃষ্টিতে চীনের সামরিক
সক্ষমতা ও বার্ষিক বাজেট ভারত অপেক্ষা তিনগুন বেশি হলেও ভূ-রাজনৈতিক ও ভৌগলিক
অবস্থান জনিত কারণে চীন কোন অবস্থায় ভারতের বিরুদ্ধে শতভাগ এমনকি শতকরা চল্লিশ
থেকে পঞ্চাশ ভাগ সামরিক শক্তি ভারতের বিরুদ্ধে প্রয়োগের কোন সুযোগ পাবে বলে মনে হয়
না। এখানে আমি বিষয়টি আমার নিজের মতো করে স্বল্প পরিসরে বিশ্লেষণ করার চেষ্ট করব। কারণ
বিগত এক দশক ধরে চীন দক্ষিণ চীন সাগরের মালিকানা এবং পূর্ব চীন সাগরের একাধিক
দ্বীপ নিয়ে সাগর সংলগ্ন জাপানসহ আটটি দেশের সাথে চরম বিবাদে জড়িয়ে আছে এবং বরাবরের
মতো বিশ্বের এক নম্বর সামরিক সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু অস্থিতিশীল
সামরিক উত্তেজনার সুযোগে বিশেষ করে উত্তর কোরিয়া এবং চীনকে সামরিক ও কৌশলগতভাবে মোকাবেলা
করার জন্য গোটা এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে ইতোমধ্যেই ব্যাপক সামরিক সমাবেশ সুসম্পন্ন
করেছে এবং নিয়মিত ভাবে অত্র অঞ্চলে যৌথ সামরিক মহড়া ও নিবিড় গোয়েন্দা নজরদারি
অব্যাহত রেখেছে। অর্থ্যাৎ এক্ষেত্রে দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সাগর ইস্যুতে চীনের যুদ্ধে
জড়ানোর অর্থই হচ্ছে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের উত্তর কোরিয়াসহ তিন চারটি দেশ বাদে
অধিকাংশ দেশ এবং বিশ্ব শান্তির মহানায়ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া প্যাসিফিক
নেভাল ও এয়ার ফ্লীটের সরাসরি মোকাবেলা করা। আর তাই চীনকে নিশ্চিতভাবে তার সামগ্রিক
সামরিক সক্ষমতার ৫০% থেকে ৬০% পর্যন্ত প্রশান্ত মহাসাগর ও দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সাগর
সংলগ্ন স্থল ও সমুদ্র সীমান্তে যুদ্ধ হোক বা না হোক এক রকম বাধ্য হয়েই কৌশলগত
ভাবেই সার্বোক্ষণিক মোতায়েন রাখতে হচ্ছে বা হবে।
আবার অস্থিতিশীল কাশ্মির
উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে ভারতের সাথে পাকিস্তানের চলমান ভয়াবহ সীমান্ত সংঘর্ষ যে
কোন মুহুর্তে বড় আকারের যুদ্ধে রুপ নিতে পারে, এমন আশাঙ্খায় ভারতকে তার সামরিক
শক্তির একটি বড় অংশ পাকিস্তান সীমান্ত জুড়ে মোতায়েন রাখতে হচ্ছে এবং অব্যাহত ভাবে
প্রতি নিয়ত সীমান্ত সংঘর্ষে উভয় পক্ষের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে
চীন কিন্তু নিজের স্বার্থেই পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সহায়তার পাশাপাশি ভারতের
বিরুদ্ধে অস্ত্র সরবরাহের মাধম্যে এক ধরণের মনস্তাত্বিক চাপ প্রয়োগের কৌশল অবলম্বন
করেছে এবং এক্ষেত্রে চীনের সাথে যে কোন ধরণের সংঘর্ষে লিপ্ত হলে পাকিস্তানের বিশাল
সীমান্ত অঞ্চল ভয়াবহ রকমের অশান্ত হয়ে উঠতে পারে এবং একই সাথে চীন ও পাকিস্তানকে
যুগৎপত ভাবে মোকাবেলা করতে হতে পারে। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার সাথে
পাকিস্তানের সামরিক সম্পর্ক ও ঘনিষ্টতা বৈশ্বিক পর্যায়ে এক নতুন সামরিক মেরুকরণ
সৃষ্টি হতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
আমরা যদি ভারত ও চীনের সামরিক
সক্ষমতা ও ভারসাম্য তুলনা করি, তাহলে সব দিক বিবেচনায় চীনকে অবশ্যই এগিয়ে রাখতে
হবে। মুলত, চীনের গ্রাউন্ড ও নেভাল ফোর্স নিশ্চিতভাবে ভারত অপেক্ষা অনেক বেশি
শক্তিশালী এবং আক্রমনাত্বক বলা চলে। আবার অন্য দিকে চীন ও ভারতের ভৌগলিক অবস্থানগত
কারণে সমুদ্র পথে দেশ দুটির মাঝে যুদ্ধের কোন সম্ভবনা আছে বলে মনে হয় না। কারণ সাত
সমুদ্র তেরো নদী পাড় হয়ে সমুদ্র পথে ভারত মহাসাগরে চীনের সাবমেরিন ভিত্তিক নেভাল
ফ্লীটের ভারত আক্রমন করা বা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা এক কথায় অসম্ভব। তাছাড়া চীনের
কাছে নিজস্ব ৬৫০০০ টনের লিয়োনিং নামে একটি আধুনিক এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ার থাকা
স্বত্তেও বাস্তবে এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ারের ব্যবহার ও অভিজ্ঞায় চীন এখনো কিন্তু ভারত
অপেক্ষা অনেক পিছিয়ে আছে। যদিও চীন ইতোমধ্যেই তাদের নিজস্ব উৎপাদিত দ্বিতীয় এয়ার
ক্রাফট ক্যারিয়ার পরীক্ষামুলক ভাবে সাগরে নামিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং চীন আগামী
২০৩০ সালের মধ্যে এ রকম আরো নতুন দুটি এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ার নেভাল ব্যাটল গ্রুপে
অন্তভুক্ত করতে এক রকম দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এদিকে এ মুহুর্তে ভারতের নেভাল ফ্লীটের
অন্যতম প্রধান ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ রনতরী হচ্ছে ৪৫ হাজার টনের আইএনএস বিক্রমাদিত্য । এই মিডিয়াম
আকারের এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ারটি ২৪টি করে মিগ-২৯কে জেট ফাইটার এবং ৬টি করে
এএসডাব্লিউ/এইডাব্লিউ হেলিকপ্টার বহন করতে পারে। রাশিয়ার কাছ থেকে ২৩৫ কোটি ডলার বা প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকায় কেনা এই এয়ার ক্রাফট ক্যারিয়ারটি ২০১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের নৌ বাহিনীতে কমিশনিং লাভ করে। তাছাড়া ভারত
সরকার ভবিষ্যত পরিকল্পনার আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের নৌ বহরে মোট তিনটি এয়ার
ক্রাফট ক্যারিয়ার সংযোজন করতে ব্যাপক ভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং যার মধ্যে কমপক্ষে
একটি থাকবে নতুন প্রজন্মের ৬৫০০০ টনের পারমানবিক শক্তিচালিত সুপার এয়ার ক্রাফট
ক্যারিয়ার আইএনএস বিশাল।
তবে এখানে চীনের গ্রাউন্ড ফোর্সের
আর্টলারি সিস্টেম ও ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবস্থা ভারতের জন্য অবশ্যই এক বড় ধরণের হুমকী ও
মারাত্বক চ্যালেঞ্জ হিসেবে থেকে যাচ্ছে যা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাছাড়া চীনের
অস্ত্র ভান্ডারে আনুমানিক ৫০০০ এর মতো স্বল্প, মাঝারি ও দূর পাল্লার
ক্ষেপনাস্ত্রসহ পারমানবিক ওয়ারহেড সমৃদ্ধ কৌশলগত ক্ষেপনাস্ত্রের সংখ্যা প্রায়
৬৮০টি হতে পারে। যেখানে ভারতে মোট ক্ষেপনাস্ত্র আনুমানিক ২০০০ এবং যার মধ্যে
কৌশলগত ক্ষেপনাস্ত্রের সংখ্যা ২০০টি বা তার কাছাকাছি থাকতে পারে। তবে সব দিক বিবেচনা করলে চীনের বিমান বাহিনীর সক্ষমতা
কিন্তু অপেক্ষাকৃত ভাবে বেশ দূর্বল ও স্পর্শকাতর। চীনের বিমান বাহিনীতে মোট ৩১০০ এর মতো সামরিক পরিবহণ, যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার
থাকলেও কিন্তু এখনো পর্যন্ত হাজার খানেক ষাট ও সত্তর দশকের জে-৭, জে-৮ এবং জেএইচ-৬
লাইট গ্রাউন্ড এট্যাক দিয়ে ভর্তি। আবার ভারতের বিমান বাহিনীতে ২১০০ এর বেশি
যুদ্ধবিমান, সামরিক পরিবহণ বিমান ও হেলিকপ্টার থাকলেও তাদের অতি পুরোনো ছয় থেকে
সাত শতাধিক যুদ্ধবিমান এখন বাতিল হবার পথে। তবে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ভারতের বিমান
বহরে থাকা চতুর্থ প্রজন্মের বিশাল আকারের ২৪০টি এসইউ-৩০এমকেআই কিন্তু চীনের জন্য
এখনো পর্যন্ত মারাত্বক হুমকি হিসেবে থেকে যাচ্ছে।
এদিকে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে চীন সাধারণত তাদের
সামরিক বাজেটের সঠিক তথ্য প্রকাশ না করলেও, ২০১৬ সালে তাদের নিজস্ব সামরিক ও
প্রতিরক্ষা বাজেট ১৪৮.৬৯ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করেছিলো এবং বর্তমান ২০১৭ সালের
জন্য তা ৭% বৃদ্ধি করে ১৬০ বিলিয়ন ডলার বা তার কাছাকাছি নির্ধারণ করেছে। এদিকে
ভারতের ২০১৬ সালের সামরিক বাজেট বরাদ্দ ছিলো ৫২.০০ বিলিয়ন
ডলার যা ২০১৭ সালের জন্য নতুন করে ৩ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি করে ৫৫.০০ বিলিয়ন ডলারে নির্ধারণ করেছে ভারতের সম্মানিত মোদি সরকার। তাছাড়া
চীর বৈরি দুই পারমানবিক শক্তিধর প্রতিবেশি চিন এবং পাকিস্তানের সাথে সাম্প্রতিক
সময়ে চরম সামরিক উত্তেজনা ও কৌশলগত চাপ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণেই ভারত এক রকম
বাধ্য হয়ে উচ্চ প্রযুক্তি সম্পন্ন অস্ত্র ও সাজ সরঞ্জাম ক্রয় বা সংগ্রহে বিপুল
বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যাচ্ছে। যেখানে গোটা এশিয়ায় চীন তার নিজস্ব আধিপত্য বিস্তার
করার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, তা ভারতকে বাধ্য করছে নিজেদের
সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা দ্রুত বাড়ানোর ছাড়া বিকল্প কোন পথ খোলা থাকছে না। ভারত
তার নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্প ক্ষেত্রকে কাজে লাগিয়ে তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষার
চাহিদা যথেষ্ট ভাবে মেটাতে পারছে না বিধায় এক রকম বাধ্য হয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র
আমদানি করতে হচ্ছে বলে মনে করা হয়। এতে করে ভারত ২০১৭ সালের জন্য তাদের নিজস্ব
সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণ ও উচ্চ প্রযুক্তি সমৃদ্ধ অস্ত্র ও সাজ সরঞ্জাম দ্বারা
সজ্জিত করতে নতুন করে ২৫ হাজার কোটি ডলারের এক মহা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তবে
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট ও ইসরাইল
সফরের মাধম্যে দেশ দুটির সাথে বৃহৎ পরিসরে সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে
যাচ্ছে যা নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যতে চীন ও পাকিস্তানকে এক ধরণের মনোস্তাত্বিক চাপে
রাখবে যা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), সহকারী শিক্ষক ও লেখক, জয়কুড়ি সরকারি
প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com
আললাহ আপনাকে নেক ও কল্যান মুলক হায়াত দান করুন আমীন ইয়া আললাহ ।
ReplyDeleteDear sur, thanks for your cordial reply and comments....regards
Delete