শিশুর একটি সুন্দর জীবন গঠনে এবং বাস্তব জীবনের সাথে নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষাস্তর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আর তাই একটি শিশুর ইতিবাচক আচারনিক পরিবর্তনে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে বর্তমানে সারা দেশব্যাপী আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ করে শহর অঞ্চলের উন্নত কেজি একাডেমী, ইংরেজি এবং সেমি-ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে শিশুরা অকল্পনীয় মানসিক ভাবে চাপের শিকার হচ্ছে। সাধারণত শহরের অধিকাংশ এমনকি উপজেলা পর্যায়ে শিশুরা মানসম্মত বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেও তাদের মা-বাবা বা অভিভাবকদের ইচ্ছা পুরণের কোন সীমা থাকে না। আর তাই এ সমস্ত অতি উৎসাহী মা-বাবারা তাদের শিশুদের একটি মানসম্মত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর পাশাপাশি ভালো ফলাফলের আশায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাঙের ছাতার মতো গজে ওঠা কোচিং সেন্টারগুলোতে নিষ্পাপ শিশুদের এক রকম নিজেদের অজান্তেই মানসিক ভাবে জিম্মি করে ফেলছেন। আসলে একটি শিশুর কাছে পড়ালেখা যেখানে খুবই আনন্দের বিষয় হওয়ার কথা ছিল তা কিন্তু এখন বাস্তবে অধিকাংশ শিশুর ক্ষেত্রেই এক রকম মারাত্মক বোঝা এবং শিক্ষাভীতি তৈরির অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
মুলত ২০১০ সালে সম্মানিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে, যার আলোকে প্রাথমিক শিক্ষাস্তরকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক এবং অবৈতনিক করার পাশাপাশি কারিগরি জ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে পর্যায়ক্রমে শিশুর যোগ্যতাভিত্তিক বা সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনে বাংলাদেশের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়, ন্যাশনাল একাডেমী ফর প্রাইমারি এডুকেশন (ন্যাপ, জেলা পর্যায়ে প্রাইমারি টির্চাস ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই) এবং ন্যাশনাল এডুকেশন অ্যান্ড টেক্সট বোর্ড সম্মিলিত ভাবে একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। এ মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে ২০১৬ সালে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত যোগ্যতাভিত্তিক পাঠ্য পুস্তক প্রনয়নসহ ইতোমধ্যেই সারা দেশব্যাপী উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের মাধ্যমে ৮০% প্রাথমিক শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে তা অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া ২০১২ সাল থেকে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় আনুপাতিক হারে গতানুগতিক প্রশ্নের পাশাপাশি যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্ন সংযোজন করা হচ্ছে এবং আশা করা যায় ২০১৮ সাল থেকে সম্পূর্ণ শতভাগ মূল্যায়ন ব্যবস্থা বা প্রশ্ন প্রণয়ন করা হবে শিশুর যোগ্যতাভিত্তিক বা সৃজনশীল ধারার আলোকে।
বাংলাদেশের শিক্ষা বিষয়ক গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান রিসার্চ ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব এডুকেশন এর এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন করে প্রবর্তিত যোগ্যতাভিত্তিক বা সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি বোঝেন না আনুমানিক ৫০% প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আবার অন্যদিকে ২৫% শিশু দুর্ভাগ্যজনক হলেও পরীক্ষার সময় যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নপত্র না বুঝেই এক রকম উত্তর প্রদান করে। আসলে যোগ্যতাভিত্তিক বা সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির গুনগত মান যাচাই এবং কার্যকারিতা নিয়ে পরিচালিত এ গবেষণামূলক প্রতিবেদনে এমন হতাশাজনক চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রকৃতপক্ষে, প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতি একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী হলেও এর সঠিক প্রয়োগ ও ব্যবহার সারা দেশব্যাপী সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সমান ভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার অন্যদিকে যোগ্যতাভিত্তিক শিখন-শেখানো পদ্ধতি চালুর পর থেকে শিশুদের উপর বইয়ের বোঝা কম হবে ধারণা করা হলেও বাস্তবে কিন্তু তা আরও বেড়ে গেছে। বর্তমানে বুঝে হোক বা না বুঝে হোক শিশুর অভিভাবকদের পাঠ্যবইয়ে পাশাপাশি অতিরিক্ত বই এবং একাধিক গাইড বা নোট বই সংগ্রহ ও ব্যবহারের বিষয়টি বেশ লক্ষণীয়। এক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে হলেও এ ধারা অব্যাহত রাখতে কিছু সংখ্যক শিক্ষকেরা অভিভাবকদের উৎসাহিত করে যাচ্ছেন যা খুবই হতাশাজনক। যেখানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নির্ধারিত পাঠ্যবইয়ে অতিরিক্ত কোনো বই স্কুলের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না এই মর্মে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের পরিষ্কার নির্দেশনা বা গাইড লাইন থাকা সত্ত্বেও অনেক স্কুল বিশেষ করে শহর পর্যায়ে অধিকাংশ বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষই তা অনুসরণ করছেন না এবং ফলশ্রুতিতে শিশুদের উপর বই এর বোঝা এবং মানসিক চাপ মারাত্মক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে প্রতিয়মান হয়।
তবে এ কথা সত্য যে আমাদের দেশের শিক্ষকগণ যে পরিমাণ বা স্তরে বেতন ভাতাদি পেতেন তা তাঁদের স্বাভাবিক জীবন পরিচালনার তুলনায় অতি নগন্য। আর এজন্য শিক্ষকদের মাঝে হতাশা ও অসন্তুষ্টি থাকাটাই স্বাভাবিক। পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে এক রকম বাধ্য হয়েই প্রাথমিক শিক্ষকদের উর্পাজনের অন্যান্য উপায়সমূহ অবলম্বন করতে হয়। বেশিরভাগ শিক্ষকরাই ছোটখাটো ব্যবসা থেকে শুরু করে প্রাইভেট পড়ানো ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত থাকেন। এসব কাজে তাঁদের অনেক সময় ও শ্রম ব্যয় করতে হয়। ফলশ্রুতিতে শ্রেনীর শিখন-শেখানো কার্যক্রমে এর নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য আশার কথা আমাদের সম্মানিত সরকার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক ও উন্নত দেশের পর্যায়ে নিয়ে যেতে বিভিন্ন ধরনের ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ইতোমধ্যেই সরকার সারা দেশব্যাপী ২৬০০০ রেজিস্টার, কমিউনিটি ও নন-এমপিও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত অসহায় ১,০০,০০০ শিক্ষক জাতীয়করন করার পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করাসহ সহকারী শিক্ষকদের একধাপ উপরে বেতন স্কেল নির্ধারণ করে নতুন জাতীয় বেতন স্কেল প্রণয়ন করেছেন যা খুব ভালো একটি ইতিবাচক দিক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এছাড়া জেলা পর্যায়ে প্রাইমারি টির্ঢাস ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই) এ সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি এবং যোগ্যতাভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষার নিশ্চিত কল্পে এক বছর মেয়াদী সি-ইন-এড কোর্সের পরিবর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এক বছর ছয় মাস মেয়াদী আধুনিক শিক্ষা ধারার আলোকে ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন কোর্স চালু করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা ও অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষা নাকি কোনো পাবলিক পরীক্ষা নয়, এগুলো মুলত শ্রেণি উত্তীর্ণের পরীক্ষা মাত্র। অথচ দেখা যায় সম্পূর্ণরূপে অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষার আদলে এ পরীক্ষা দুটি নেয়া হচ্ছে। যেখানে জাপানের মতো উন্নত দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত শিশুদের কোন ধরনের পরীক্ষা নেয়া হয় না। আসলে জাপানের আইন অনুযায়ী ১০ বছরের আগে শিশুদের গতানুগতিক পরীক্ষা নেয়া সম্পূর্ণ অবৈধ। এর অর্থ হচ্ছে জাপানে ১০ বছর পর্যন্ত শিশুদের নৈতিক শিক্ষা, আচার-আচরণ, শিষ্টাচার বাস্তবমুখী প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা প্রদান করা হয় এবং তারা বিশেষ করে শিশুর কারিগরি জ্ঞান বিস্তারে অতি সচেতন ও যত্নশীলও বটে।
যা হোক আমাদের দেশের নতুন শিক্ষা আইনে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করা হয়েছে এবং এর আলোকে পঞ্চম শ্রেণিতে বর্তমানে প্রচলিত প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা ২০১৮ সাল থেকে আর থাকছে না। নিঃসন্দেহে এটি একটি সঠিক ও যুগোপযোগী সাহসী পদক্ষেপ। এমনিতেই আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা বিশেষভাবে পরীক্ষা কেন্দ্রিক পদ্ধতির উপর অতি মাত্রায় নির্ভরশীল। যা কোনো অবস্থাতেই উন্নত দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যাবস্থার সাথে তুলনা করা চলে না। এখনো পর্যন্ত আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষাস্তর থেকে উচ্চ শিক্ষার সর্বক্ষেত্রেই মূল বিষয়বস্তু না বুঝেই মুখস্ত করে উত্তর প্রদানের প্রবনতা লক্ষণীয়। আর এতে করে শিশুরা হয়ে উঠেছে অতি মাত্রায় পরীক্ষা কেন্দ্রীক প্রতিযোগিতামুখী এবং ফলস্বরুপ শিশুর বাস্তবমুখী জ্ঞান অর্জন ও সৃজনশীল চিন্তা ভাবনার বিকাশ মারাত্মক ভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে যা বলার অপেক্ষা রাখে না। যাই হোক আমাদের অবশ্যই এই প্রবণতা থেকে সরে এসে শিশুর শিক্ষাভীতি দূর করে আনন্দজনক ও শিশুবান্ধব পরিবেশে ডিজিটাল ও প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক শিক্ষা নিশ্চিত কল্পে সবাইকে একযোগে আন্তরিক ও ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কাজ করে যেতে হবে।
সিরাজুর রহমান, সহকারী শিক্ষক,
জয়কুড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,
সিংড়া, নাটোর।
sherazbd@gmail.com

Comments

Popular posts from this blog

এক লিজেন্ডারী যুদ্ধবিমান এফ-১৪ টমক্যাট ফাইটার জেটঃ

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার দ্রুত বাস্তবায়ন আর কত দূরে ?

এবার আমেরিকার এফ-১৬ যুদ্ধবিমান পেতে যাচ্ছে তুরস্কঃ